আইনস্টাইন এর গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার বা কাজ সমুহ
আইনস্টাইন, নিউটনের মতো বড় বড় বিজ্ঞানীদের কাজের পরিধি এত ভবিশাল এবং ব্যাপক যে তার মধ্য থেকে বেশী গুরুত্বপূর্ণ কাজ খোঁজাই মুশকিল। মানে অনেকটা বিয়েবাড়িতে খেতে বসে কেউ যেন জিজ্ঞেস করছে,”কী নেবেন? চিলি চিকেন না পনীর? মাটনকষা না চিকেনকষা? চিংড়ি না ইলিশ? মিষ্টি না আইসক্রিম?” আরে বাবা এসব কেউ কি জিজ্ঞেস করে নাকি! সবই নিয়ে আসতে হয়। কোনোকিছু ছাড়া যায় না।
মহান বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের ব্যাপারটাও অনেকটা এইরকম। পদার্থবিজ্ঞানের এমন এক একটা ক্ষেত্র তিনি তৈরি করে দিয়ে গেছেন যার উপর নির্ভর করে অসংখ্য বিজ্ঞানী গবেষণা করে গেছেন এবং আজও করছেন। হয়তো ভবিষ্যতেও চলবে। তবু তার মধ্যে থেকে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের কথা বলবো।
ব্রাউনীয় গতি (Brownian motion) বলতে কি বোঝায়?
১৮২৭ সালে রবার্ট ব্রাউন জলের মধ্যে ফুলের রেণুর এলোমেলো গতি লক্ষ্য করেন। তখন তিনি এই গতির কারণ ব্যাখ্যা করতে পারেন নি। শুধু ফুলের রেণু নয়, আরো অনেক তরলে বিভিন্ন পদার্থের কণার মধ্যে এই গতি লক্ষ্য করা যায়। এই ঘটনা ব্রাউনীয় গতি নামে পরিচিত।
প্রায় ৮০ বছর পরে আইনস্টাইন এই ঘটনাকে ব্যাখ্যা করেন। তার মতে, পদার্থের কণাগুলির তাপীয় গতির জন্য তরল পদার্থের মধ্যে থাকা ক্ষুদ্র কণাগুলির এইরকম এলোমেলো গতি লক্ষ্য করা যায়। তিনি একটি গাণিতিক সূত্র দেন এই গতির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে। সহজ করে বোঝানোর জন্য গাণিতিক সূত্রটি আর বললাম না।
ভর ও শক্তির তুল্যতা নীতি ( Mass- Energy equivalence) বলকে কি বোঝায়?
এই নীতির কথা কমবেশি আমরা সবাই জানি বা শুনেছি বা পড়েছি। সম্ভবত সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণীর বইতে এই নীতির কথা দেখতে পাওয়া যাবে। তাই যারা বিজ্ঞান নিয়ে পরে পড়াশোনা করেননি তারাও জানেন
E=mc2
যেখানে,
E= শক্তি,
m=পদার্থের ভর
এবং c= শূন্য মাধ্যমে আলোর বেগ।
আপাতদৃষ্টিতে খুবই নিরীহ একটি সমীকরণ যার মধ্যে কোনো জটিলতা নেই। আমার কাছে যদি m ভরের কোন বস্তু থাকে তাহলে ঐ বস্তু থেকে আমি উপরের সূত্রানুযায়ী E পরিমাণের শক্তি পাবো। সাধারণ লোকে দেখলে ভাববে, তিনটা আলাদা আলাদা জিনিস নিয়ে (যাদের নিজেদের মধ্যে তেমন কোনো মিল নেই) একটা সমীকরণ বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাস্তবে আলু পটোল কিনতে গেলে কোথাও কাজে লাগবে না। অথচ এই সহজ এবং সরল জিনিসের মধ্যে এমন গভীর জিনিস লুকিয়ে আছে যে, হিরোশিমার মত ঘটনা ঘটতে পারে ওই ছোট্ট একটা সমীকরণ থেকে!
ওই সমীকরণটিকে যদি আর একটু ব্যাখ্যা করা যায় তাহলে বলতে পারি ভর আর শক্তি একই জিনিস। মানে কেউ যদি বলে পদার্থের ভর x কিলো সেটাও ঠিক আবার কেউ যদি বলে পদার্থের ভর y জুল, তাহলে সেটাও ঠিক। একটা ছোট উদাহরণ দিয়ে সমীকরণটির ব্যাপকতা বোঝানো যেতে পারে। মানে আপনার কাছে যদি ১ কেজি ভরের বস্তু থাকে এবং তাকে যদি সম্পূর্ণ শক্তিতে রুপান্তরিত করা যায় তবে আপনি যে পরিমান শক্তি পাবেন তার পরিমাপ হল ৯* ১০^১৬ জুল। ঠিক বুঝতে পারলেন না তো কত শক্তি? তাহলে বলা যেতে পারে, এই শক্তি ৪০ মেগাটন টিএনটি বোমার শক্তির সমান!
এতেও ধারনা করতে পারলেন না? তাহলে বলি এই পরিমাণ শক্তি দিয়ে ১০ মিলিয়ন লোকের বাড়ীতে তিন বছর ধরে কারেন্ট সরবরাহ করা যেতে পারে! এবার ধারণা করতে পারলেন মাত্র ১ কেজি ভরের বস্তু দিয়ে কি তুলকালাম কাণ্ড করা যেতে পারে?
আলোক তড়িৎ ক্রিয়া (Photoelectric effect) কি?
এই একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার যার জন্য তিনি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল প্রাইজ পান ১৯২১ সালে। এই ঘটনাটা খুবই সহজ করে বোঝানো যায়। মানে ধরুন, আপনার কাছে এক আশ্চর্য পদার্থ আছে। এবার আইনস্টাইন ওর উপর আলো ফেললেন। আপনি অবাক হয়ে দেখলেন আলো ফেলার সাথে সাথে তড়িৎ শক্তি পাওয়া যাচ্ছে! ভয়ঙ্কর ব্যাপার না! কষ্ট করে কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ তৈরি করতে হচ্ছে না। ওই আশ্চর্য পদার্থের উপর আলো ফেলুন আর তড়িৎ শক্তি পেয়ে যান সাথে সাথে।
দৈনন্দিন জীবনে একে ব্যবহার করতে চান? বাড়ীতে “সোলার সিস্টেম” বসিয়ে নিন আর সরকার থেকে যে বিদ্যুৎ আপনাকে দেয় তাকে টা টা বাই বাই করে দিন। আপনার অনেক সেভিংস হবে এবং পরিবেশকেও সুস্থ রাখবেন (পরিবেশ দূষণ ঘটায় না এই বিদ্যুৎ)। এমনি এমনি কি আর আইনস্টাইন নোবেল পেয়েছিলেন! আমি শুধু সোলারের কথা বললাম মানে এই নয় যে এটাই একমাত্র উদাহরণ। আরও অনেক কাজ করা হয় এই ঘটনার উপর ভিত্তি করে। আমি তেমন কঠিন কিছু বলব না বা কোন জটিল সমীকরণও দেবো না। আরও জানতে হলে একটু উইকিপিডিয়া ঘুরে আসুন।
আইনস্টাইন এর রেফ্রিজারেটর (Einstein’s Refrigerator) মডেল।
এই আবিস্কারের কথা লোকে ততটা জানেনা যতটা জানে অন্যান্য আবিস্কারের সম্পর্কে। উনি এমন এক রেফ্রিজারেটর তৈরি করেন যেটা খুবই কম শক্তি ব্যবহার করে রেফ্রিজারেটরকে সচল রাখার জন্য। শুধু লাগে অ্যামোনিয়া, জল আর বিউটেন। উপরের ছবিটা শুধু দেখানোর জন্য দিলাম, কীভাবে কাজ করে তার আর ব্যাখ্যা দিতে যাব না। বর্তমান সময়ে যে শক্তির সমস্যা আছে তাতে এই কম শক্তির রেফ্রিজারেটর খুবই কাজে দেবে। তাই বিজ্ঞানীরা এর উপর আরও গবেষণা করে যাচ্ছেন।
এতক্ষণ যে কয়টা আবিস্কারের কথা বললাম তা খুবই সহজ। মানে কারুরই তেমন বুঝতে অসুবিধা হবে না। কিন্তু এবার আরও তিনটে আবিস্কারের কথা বলবো যা তুলনামূলকভাবে বোঝার জন্য কঠিন।
বোস আইনস্টাইন কনডেনসেট (Bose-Einstein Condensate (BEC) কি?
আমাদের গর্বের বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু জড়িয়ে আছেন এই আবিস্কারের পেছনে। তিনি বোস সংখ্যায়ন (Bose statistics) দেবার পর আর তেমন গভীরভাবে এই বিষয় নিয়ে কাজ করেননি। আইনস্টাইন এই বিষয়ের গভীরে গিয়ে ভাবতে শুরু করেন এবং খুঁজে পান “বোস আইনস্টাইন কনডেনসেট” কে।
এইজন্য এখন বোস সংখ্যায়ন, বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন বা Bose-Einstein statistics নামে পরিচিত। খুব সহজ করে BEC এর ব্যাপারে যদি বলা যায় তাহলে বলতে হয়- খুব কম তাপমাত্রায় বলা ভাল পরম শূন্য তাপমাত্রার খুব কাছে পদার্থের পরমানু বা পরমানু সদৃশ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কনাগুলি সবচেয়ে নীচের শক্তির স্তরে (Ground state) অবস্থান করে এবং তখন ওই সিস্টেমকে একটিমাত্র Wave function দিয়ে প্রকাশ করা যায়। আর একেই তখন বলে বোস আইনস্টাইন কনডেনসেট।
[su_quote]ধরা যাক, কোন মন্দিরে শুধুমাত্র এক পুরোহিত আর তার স্ত্রী থাকেন। তারাই মন্দির দেখাশোনা করেন সারা বছর। কখনো আর কাউকে দেখতে পাওয়া যায় না ওই মন্দিরে। শুধুমাত্র একা পুরোহিত অনেকসময় সব কাজ সামলে নেয় কিংবা কখনো ওর স্ত্রী কিংবা দুজনেই। আর কখনো কেউ এই নির্জন মন্দিরে আসে না। মানে কখনো দুইয়ের বেশী লোক ওই মন্দিরে পাওয়া যাবে না।[/su_quote]
[su_quote]একবার দেশজুড়ে খুব বৃষ্টি, বন্যা হল। দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। দলে দলে মানুষ গ্রাম ছাড়া হয়ে এদিক ওদিক যেতে লাগলো। সেইসময় অনেক মানুষ এসে ওই মন্দিরে আশ্রয় নিল। আগে যেখানে এক পুরোহিত আর তার স্ত্রী থাকতো এখন সেখানে একাধিক লোক থাকতে লাগলো।[/su_quote]
ইলেকট্রনের ক্ষেত্রে কোন অবস্থাতেই পাউলির অপবর্জন নীতি লঙ্ঘন করা সম্ভব নয়। মানে কেবলমাত্র দুটি ইলেকট্রন একটি state এ থাকতে পারে। সহজ করে বললে, যার একটা ঘূর্ণন উপরের দিকে তো অপরটার নীচের দিকে। কিন্তু BEC এর এক্ষেত্রে দুটি নয়, একাধিক থাকতে পারে একটি দশায় (state)। এখান থেকে কনার আরও একটি শ্রেণী পাওয়া গেল যা পাউলির অপবর্জন নীতি মানেনা।
ওই শ্রেণীর কণা আজ “বোসন” নামে পরিচিত। ফলে প্রথম উদাহরণটিকে যদি আমারা ইলেকট্রন বা ফেরমিয়ন দিয়ে বোঝাই তো দ্বিতীয় উদাহরণ হল বোসন। যেখানে “প্রাকৃতিক দুর্যোগ” হল পরম শূন্য তাপমাত্রার কাছাকাছি কোন তাপমাত্রা।
বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ (Special Theory of Relativity) বলতে কি বোঝায়?
এটাতো এখন পদার্থবিজ্ঞানের একটি শাখা যা শুরু করেছিলেন আইনস্টাইন ১৯০৫ সালে। ওইসময় ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ডের ব্যাপার স্যাপারগুলো তথাকথিত ক্ল্যাসিকাল মেকানিক্স দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল না। তিনি চেষ্টা করলেন এসবের ব্যাখ্যা দিতে। যিনি পরিমাপ করছেন তার গতির উপর নির্ভর করে বা নির্দেশতন্ত্রের উপর নির্ভর করে কীভাবে অবস্থান পরিবর্তিত হয় আইনস্টাইন সেই ধারণা দিলেন এই তত্ত্বের মাধ্যমে।
শুধু অবস্থান নয়, সময় ও যে আপেক্ষিক সেই ধারণা পাওয়া যায়। আমাদের ব্যাবহারিক জীবনে এর প্রভাব খুব একটা দেখতে পাওয়া যাবে না। কিন্তু কোন বস্তু যদি খুব বেশী বেগে (আলোর বেগের কাছাকাছি) গতিশীল হয় তখন প্রয়োজন বুঝতে পারা যায় এই তত্ত্বের। আমি একটা উদাহরণ দিয়ে এই তত্ত্বের প্রয়োগ বোঝাব যেখানে সময় যে আপেক্ষিক তা বোঝা যাবে।
মিউওন হল ইলেকট্রনের মতই একটি মৌলিক কণা। এর লাইফ টাইম হল ২.২ মাইক্রো সেকেন্ড। এর মানে হল, আমি যদি ১০০ তা মিউওন নিয়ে পরীক্ষা শুরু করি তবে ২.২ মাইক্রো সেকেন্ড পর আমার কাছে থাকবে ৫০ টি। আরও ২.২ মাইক্রো সেকেন্ড পর থাকবে ২৫ টি। এইভাবে মিউওনের সংখ্যা কমতে থাকবে। এটি বায়ুমণ্ডলের উপরিভাগে সৃষ্টি হয়। এখন এই কণা যদি আলোর বেগেও যাতায়াত করে তবে ওই কণা ধ্বংস হবার আগে প্রায় ৬০০ মিটারের কাছাকাছি এগিয়ে যাবে। মানে ৬০০ মিটার পর আর কোন মিউওন পাওয়া যাবে না।
এখন এই মিউওন সৃষ্টি হয় ভূপৃষ্ঠ থেকে কয়েক কিলোমিটার উপরে। তাহলে উপরের ক্যাল্কুলেশান অনুযায়ী ভূপৃষ্ঠে মিউওন পাওয়ার কথা নয়। অথচ আমরা যদি পরীক্ষা করে দেখি তাহলে অনেক মিউওন পাব এই ভূপৃষ্ঠে দাঁড়িয়ে। তাহলে এই ঘটনার ব্যাখ্যা কি? আইনস্টাইনের এই আপেক্ষিক তত্ত্বের সাহায্যে আমরা দেখব এই ২.২ মাইক্রো সেকেন্ড সময় অনেক বেড়ে গিয়েছে। ফলে এখন যেটা মাত্র ৬০০ মিটার যেতে পারছে তখন দেখব সেটা কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত যাচ্ছে! কি আশ্চর্য ব্যাপার না?
সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ (General Theory of Relativity) বলতে কি বোঝায়?
এই তত্ত্ব অনেকটা আগের তত্ত্বের enlarged and advanced ভারসান। বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ এর সঙ্গে যদি নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব যোগ করে দেই, তবে যা পাওয়া যায় তা হল এই সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ। এই তত্ত্ব মূলত জড়ত্বীয় ভর ও মহাকর্ষীয় ভরের সমতুল্যতা দেখায়। কীভাবে মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র সৃষ্টি হয় তা বুঝতে পারা যায়। ব্যাপক অর্থে মহাকর্ষ সম্পর্কে গভীর ভাবে জানার জন্য এই তত্ত্বের প্রয়োজন। যারা আরও এই ব্যাপারে জানতে চান তারা উইকিপিডিয়া দেখতে পারেন। (একটু কঠিন জিনিস। আমার নিজেরও ঠিক জানা নেই!!)