পদার্থ

কোরিওলিস বল কাকে বলে এবং কোরিওলিস বলের ধারণা ও এর প্রভাব?

কোরিওলিস বল কি এবং কোরিওলিস বলের প্রভাব?

পৃথিবীর আবর্তনজনিত ঘূর্ণনের প্রভাবে ভূপৃষ্ঠস্থ যে কোনো স্বচ্ছন্দ, গতিশীল বস্তুর উপর একধরনের বল কাজ করে, যা উক্ত বস্তুর দিক বিক্ষেপ ঘটায় । এই বলকে কোরিওলিস বল (Coriolis Force) বলে ।

কোরিওলিস বলের নামকরণ

উনবিংশ শতকের ফরাসী গণিতবিদ ও বিজ্ঞানী গুস্তাভ-গাসপার্ড ডি কোরিওলিস (Gustave-Gaspard De Coriolis, 1792-1843) সর্বপ্রথম ঘূর্ণনসাপেক্ষে গতিশীল বস্তুর দিক বিক্ষেপকারী এই প্রকার বলের বিষয়ে আলোকপাত করেন বলে তাঁর নামানুসারে এই বলের নাম কোরিওলিস বল রাখা হয়েছে ।

 

কোরিওলিস বলের প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখা

কোরিওলিস প্রভাব বলতে পদার্থবিদ্যায় গতিশীল বস্তুসমূহের আপাত বিচ্যুতি বোঝায়। বস্তুসমূহের গতিকে এইক্ষেত্রে একটি ঘূর্ণনশীল প্রসঙ্গ কাঠামোর সাপেক্ষে বর্ণনা করা হয়। ঘড়ির কাটার দিকে ঘূর্ণনশীল প্রসঙ্গ কাঠামোতে, বস্তুর গতির দিকের বামে বিচ্যুতি ঘটে। আর ঘড়ির কাটার বিপরীত দিকে ঘূর্ণনের ক্ষেত্রে, বিচ্যুতি ঘটে ডানে। যদিও অনেকেই এই ঘটনা ইতোপূর্বে লক্ষ করেছিলেন, তবে ১৮৩৫ সালে ফরাসি বিজ্ঞানী গ্যাসপার-গুস্তাভ কোরিওলিস প্রথম গাণিতিক বর্ণনা প্রকাশ করেন।

তিনি এর সাথে ওয়াটার হুইল ( যার মাধ্যমে জলবিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হয় ) তত্ত্বের সাদৃশ্য দেখতে পেয়েছিলেন। বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগ থেকেই কোরিওলিস বল টার্মটি আবহবিদ্যা/বায়ুবিজ্ঞান এর সম্পৃক্তে ব্যবহৃত হতে থাকে।

নিউটনের গতির দ্বিতীয় সূত্র একটি সুষম গতির জড় প্রসঙ্গ কাঠামোতে কোন বস্তুর গতি বর্ণনা করে। যখন নিউটনের সূত্রগুলোকে একটি সুষম ঘূর্ণনশীল প্রসঙ্গ কাঠামোতে স্থানান্তর করা হয়, তখন কোরিওলিস ও কেন্দ্রবিমুখী বলের উদ্ভব ঘটে। উভয় বলই বস্তুর ভরের সমানুপাতিক। কোরিওলিস বল ঘূর্ণন হারের সমানুপাতিক আর কেন্দ্রবিমুখী বল ঘূর্ণন হারের বর্গের সমানুপাতিক। কোরিওলিস বল তার ঘূর্ণন অক্ষের লম্বদিকে ও ঘূর্ণন কাঠামোতে বস্তুর গতির দিকে ক্রিয়া করে এবং এটি ঘূর্ণন কাঠামোতে বস্তুর গতির সমানুপাতিক।

See also  ডায়োড এবং রেকটিফায়ার কি, কিভাবে কাজ করে?

কেন্দ্রবিমুখী বল ব্যাসার্ধ বরাবর বাইরের দিকে ক্রিয়া করে এবং এটি ঘূর্ণন কাঠামোর অক্ষ থেকে বস্তুর দূরত্বের সমানুপাতিক। এই অতিরিক্ত বলগুলোকে বলা হয় নিষ্ক্রিয় বল, কাল্পনিক বা ছদ্ম বল। এই বলগুলো কোন কাঠামো ব্যবস্থায় নিউটনের সূত্রগুলোর প্রয়োগে ভূমিকা রাখে। এরা হচ্ছে সংশোধন গুণক [ কারেকশন ফ্যাক্টর ] যাদের সুষম গতিশীল বা জড় প্রসঙ্গ কাঠামোতে কোন অস্তিত্ব নেই।

কোরিওলিস বল কাকে বলে

কালো বলটি ছবির উপরের অংশের জড় প্রসঙ্গ কাঠামোতে একটি সরলরেখায় চলছে। কিন্তু ঘূর্ণনশীল/অ-জড় প্রসঙ্গ কাঠামোতে অবস্থানকারী দর্শক ( লাল বিন্দু ) [ ছবির নিচের অংশে ] কাঠামোতে ক্রিয়াশীল কোরিওলিস ও কেন্দ্রবিমুখী বলের প্রভাবে বলটিকে বেঁকে যেতে দেখবেন।

 

আমাদের পরিচিত একটি প্রসঙ্গ কাঠামো হচ্ছে পৃথিবী। কোরিওলিস প্রভাব পৃথিবীর ঘূর্ণন এবং বস্তুর জড়তার কারণে ঘটে থাকে। যেহেতু পৃথিবী প্রতিদিন মাত্র একটি ঘূর্ণন সম্পন্ন করে তাই কোরিওলিস প্রভাবের প্রভাব খুবই সামান্য অনুভূত হয়। সাধারণভাবে বিস্তৃত দূরত্ব ও দীর্ঘ সময় ধরে সংঘটিত গতির ক্ষেত্রে যেমন, আবহমণ্ডলে বায়ুর গতিশীলতা বা সমুদ্রের পানির ক্ষেত্রে তা বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। এই গতিগুলো পৃথিবীপৃষ্ঠ দ্বারা আবদ্ধ থাকায় কোরিওলিস বলের শুধু অনুভূমিক উপাংশটিই গুরুত্বপূর্ণ।

See also  পরমাণু কে মাইক্রোস্কোপের নিচে কেমন দেখায়?

এই বল পৃথিবী পৃষ্ঠের উত্তর গোলার্ধে বস্তুর ডানদিকে (গতির দিকের সাপেক্ষে) এবং দক্ষিণ গোলার্ধে বামদিকে বেঁকে যাবার জন্য দায়ী। এই অনুভূমিক বিচ্যুতি প্রভাব মেরুসমূহের নিকট সর্বোচ্চ এবং বিষুব রেখায় সর্বনিম্ন। এর কারণ উত্তর বা দক্ষিণে ভ্রমণ করার সময় বস্তু যতই মেরুর নিকটবর্তী হয় অক্ষাংশ বৃত্তের ব্যাসের পরিবর্তনের হার ততই বৃদ্ধি পায়। বাতাস এবং স্রোত অঘূর্ণনশীল কাঠামোতে সরাসরি উচ্চ বায়ুচাপের অঞ্চল থেকে নিম্ন বায়ুচাপের অঞ্চলে ধাবিত হয়।

কিন্তু কোরিওলিস প্রভাবের ক্ষেত্রে তারা বিষুবরেখার উত্তরে ডান দিকে এবং দক্ষিণে বাম দিকে বিচ্যুত হওয়ার প্রবণতা দেখায়। এটি বড় বড় সাইক্লোনের ঘূর্ণনের জন্য দায়ী। কোনরূপ যৌক্তিক বিশ্লেষণ ছাড়াই এটাকে ব্যাখ্যা করতে গেলে বলা যায়, একটি বস্তু বিবেচনা করুন যেটি বিষুবরেখা থেকে উত্তরমুখী গতিশীল ও বিষুবরেখায় এর গতি বজায় রাখায় প্রবণতা দেখায় যেখানে “অনুভূমিক ব্যাস” বৃহত্তর ( পৃথিবী গোলককে পর্যবেক্ষণ করলে ডানদিকে ঘূর্ণনশীল বলে মনে হবে) এবং ফলস্বরূপ উত্তরমুখী হয়ে অতিক্রম করার সময় এটি ডানদিকে বেঁকে যাওয়ার প্রবণতা দেখায় যেখানে “অনুভূমিক ব্যাস” ক্ষুদ্রতর ( অক্ষাংশের রিং ) এবং পৃথিবীর কেন্দ্রীয় অক্ষের চারদিকে বস্তুসমূহের গতি ধীর।

উনবিংশ শতকের ফরাসী গণিতবিদ ও বিজ্ঞানী গুস্তাভ-গাসপার্ড ডি কোরিওলিস (Gustave-Gaspard De Coriolis, 1792-1843) সর্বপ্রথম ঘূর্ণনসাপেক্ষে গতিশীল বস্তুর দিক বিক্ষেপকারী এই প্রকার বলের বিষয়ে আলোকপাত করেন বলে তাঁর নামানুসারে এই বলের নাম কোরিওলিস বল রাখা হয়েছে ।

কোরিওলিস ধারণার প্রেক্ষাপট

কোরিওলিস বল বলতে পদার্থবিদ্যায় গতিশীল বস্তুসমূহের আপাত বিচ্যুতিকে বোঝায়। বস্তুসমূহের গতিকে এক্ষেত্রে একটি ঘূর্ণায়মান কাঠামোর সাপেক্ষে বর্ণনা করা হয়। যেমন – কাঠামোটিতে ঘড়ির কাঁটার দিকে ঘূর্ণনে বস্তুর গতিবিক্ষেপ বামদিকে এবং ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে ঘূর্ণনে ডানদিকে বিচ্যুতি ঘটে। বিজ্ঞানী কোরিওলিস এই ঘটনার উপর ভিত্তি করে সর্বপ্রথম ঘূর্ণনের ফলে সৃষ্ট গতিশীল বস্তুর গতিবিক্ষেপসংক্রান্ত ধারণাটি গাণিতিকভাবে প্রকাশ করেন, যা বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগ থেকেই আবহবিদ্যায় পৃথিবীর ঘূর্ণনের সাপেক্ষে গতিশীল বস্তুর গতিবিক্ষেপসংক্রান্ত আলোচনার ভিত্তি হিসাবে কোরিওলিস বল নামে ব্যবহৃত হতে থাকে।

See also  চল বিদ্যুৎ নিয়ে জ্ঞানমুলক কিছু প্রশ্ন

 

কোরিওলিস ধারণার ব্যাখ্যা

কোরিওলিস বল পৃথিবীর ঘূর্ণন ও বস্তুর জড়তার কারণে ক্রিয়াশীল হয়। সমগ্র পৃথিবীর উপর কোরিওলিস বলের প্রভাব খুব সামান্যই অনুভূত হলেও গতিশীল বস্তু তথা – বায়ুপ্রবাহ, সমুদ্রস্রোত প্রভৃতির গতিবিক্ষেপের ক্ষেত্রে এই বলের প্রভাব বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। এই অনুভূমিক বিক্ষেপ নিরক্ষরেখায় সর্বনিম্ন এবং মেরুদ্বয়ের নিকট সর্বোচ্চ হয়। এর কারণ উত্তর বা দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে গতিপ্রাপ্ত বস্তু যতই মেরুর নিকটবর্তী হতে থাকে ততই অক্ষাংশ বৃত্তের ব্যাসার্ধ পরিবর্তনের হারও বৃদ্ধি পেতে থাকে।

 

কোরিওলিস বলের বৈশিষ্ট্য

কোরিওলিস বল – এর বৈশিষ্ট্যগুলি হলো নিম্নরূপ –

ক) এটি সর্বদা বায়ুপ্রবাহের অনুভূমিক দিকের সমকোণে ক্রিয়াশীল হয়।

খ) এই বলের পরিমাণ পৃথিবীর সর্বত্র সমান নয়, বিভিন্ন অক্ষাংশে এর মান বিভিন্ন মাত্রার; যথা – নিরক্ষীয় অঞ্চলে তথা ০° অক্ষাংশে ০%, ৩০° – ৫০° অক্ষাংশে ৫০%, ৬০° – ৮০° অক্ষাংশে ৮৫% – ৯০% এবং মেরু অঞ্চলে তথা ৯০° অক্ষাংশে ১০০%।

Related Articles

Back to top button