তেজস্ক্রিয়তা কাকে বলে ও মাদাম কুরীর পরীক্ষা
তেজস্ক্রিয়তা (Radioactivity) সম্পর্কে বিস্তারিত।
কোন কোন ভারী মৌলিক পদার্থের একটি গুণ যেগুলোর নিউক্লিয়াস থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অবিরত আলফা, বিটা ও গামা রশ্মি বিকরীত হয় তাকে তেজস্ক্রিয়তা বলে।
আমরা সবাই জানি একটা পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে নিউক্লিয়াস, সেখানে থাকে প্রােটন এবং নিউট্রন। পরমাণুর নিউক্লিয়াসে যতগুলাে প্রােটন থাকে ঠিক ততগুলাে ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসকে ঘিরে ঘুরতে থাকে। নিউক্লিয়াসের ব্যাসার্ধ পরমাণুর ব্যাসার্ধ থেকে প্রায় লক্ষ গুণ ছােট। নিউক্লিয়াসের আকার খুবই ছােট হলেও একটা পরমাণুর মূল ভরটি আসলে নিউক্লিয়াসের ভর, তার কারণ ইলেকট্রনের ভর প্রােটন কিংবা নিউট্রনের ভর থেকে 1800 গুণ কম।
প্রােটন পজিটিভ চার্জযুক্ত (ধনাত্মক আধান) তাই শুধু প্রােটন দিয়ে নিউক্লিয়াস তৈরি হতে পারে না, তাহলে প্রবল বিকর্ষণে প্রােটনগুলাে ছিটকে যাবে। সেজন্য নিউক্লিয়াসের ভেতরে প্রােটনের সাথে চার্জহীন নিউট্রনও থাকে এবং নিউট্রন আর প্রােটন মিলে প্রবল শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বলের আকর্ষণে নিউক্লিয়াসগুলাে স্থিতিশীল থাকতে পারে। সাধারণ হাইড্রোজেনের কেন্দ্রে একটি মাত্র প্রােটন থাকলেও বাড়তি একটি কিংবা দুটি নিউট্রনসহ হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াসও রয়েছে।
কিভাবে তেজস্ক্রিয়তার আবিস্কার হল?
ফরাসি বিজ্ঞানী হেনরি বেকেরেল (1852 – 1908) তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কার করেন। ১৮৯৬ সালে তিনি দেখতে পান যে, ইউরেনিয়াম যৌগের নিকটে রাখা ফটোগ্রাফিক প্লেট কুয়াশা বা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। তিনি অনুধাবন করেন যে, ইউরেনিয়াম থেকে নির্গত বিকিরণের দরুন ফটোগ্রাফিক প্লেট ঝাপসা হয়েছে।
এ ঘটনাকে বলা হয় তেজক্রিয়তা বা তেজস্ক্রিয় ক্ষয়। তিনি দেখান যে, ইউরেনিয়ামের নিউক্লিয়াস থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অবিরত এই বিকিরণ নির্গত হয়। এই বিকিরণ অতি উচ্চ ভেদন ক্ষমতাসম্পন্ন এবং সাধারণ আলফা কণা বা বিটা কণা। আলফা কণা বা বিটা কণা যে কণাই নির্গত হােক না কেন আদি (parent) মৌলটি (জনক) সম্পূর্ণ নতুন মৌলে (জাতক) রূপান্তরিত হয়।
যতক্ষণ পর্যন্ত না একটি স্থায়ী মৌলে রূপান্তরিত হয় ততক্ষণ এই রূপান্তর প্রক্রিয়া চলতে থাকে। তেজস্ক্রিয়তা ঘটনাটি স্বতঃস্ফূর্ত এবং সম্পূর্ণভাবে প্রকৃতি নিয়ন্ত্রিত। এটি তাপ, চাপ, বৈদ্যুতিক বা চৌম্বক ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত হয় না। | পরবর্তীকালে রেডিয়াম, পােলােনিয়াম, খােরিয়াম, অ্যাকটেনিয়াম ইত্যাদি ভারী মৌল থেকে তেজস্ক্রিয় রশি বা কণার নির্গমন আবিষ্কৃত হয়। যে সকল মৌল থেকে তেজস্ক্রিয় রশ্মি নির্গত হয় তাদেরকে তেজস্ক্রিয় মৌল বলে।
তেজস্ক্রিয়তা রশ্নি কাকে বলে?
নিউক্লিয়াসের ভেতরে প্রােটনের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে সেটাকে স্থিতিশীল রাখার জন্য নিউট্রনের সংখ্যাও বেড়ে যেতে থাকে, কিন্তু তারপরও নিউক্লিয়াসের ভেতরে প্রােটনের সংখ্যা ৪2 অতিক্রম করার পর থেকে নিউক্লিয়াসগুলাে অস্থিতিশীল হতে শুরু করে। অস্থিতিশীল নিউক্লিয়াসগুলাে কোনাে এক ধরনের বিকিরণ করে স্থিতিশীল হওয়ার চেষ্টা করে এবং এই প্রক্রিয়াটাকে আমরা বলি তেজস্ক্রিয়তা। নিউক্লিয়াসের ভেতর থেকে যে বিকিরণ বের হয়ে আসে সেটাকে তেজস্ক্রিয় রশ্নি বলে ।
নিউক্লিয়াসের ভেতরে প্রােটনের সংখ্যা 82 অতিক্রম করলেই (পারমাণবিক সংখ্যা 82 থেকে বেশি) যে নিউক্লিয়াসগুলাে তেজস্ক্রিয় হয়ে থাকে তা নয়, অন্য পরমাণুর নিউক্লিয়াসও তেজস্ক্রিয় হতে পারে। আমরা পরমাণুর শ্রেণিবিন্যাস করেছি তার ইলেকট্রনের সংখ্যা দিয়ে, যেটা প্রােটনের সংখ্যার সমান। একটি মৌলের বাহ্যিক ধর্ম, প্রকৃতি, রাসায়নিক গুণাগুণ সবকিছু নির্ভর করে বাইরের ইলেকট্রনের শ্রেণিবিন্যাসের ওপর। কাজেই কোনাে একটি মৌলের পরমাণুতে তার ইলেকট্রন এবং প্রােটনের সংখ্যা সুনির্দিষ্ট হলেও নিউট্রনের সংখ্যা ভিন্ন হতে পারে।
ভিন্ন নিউট্রন সংখ্যায় নিউট্রনযুক্ত নিউক্লিয়াসের পরমাণুকে বলা হয় সেই মৌলের আইসােটোপ। কাজেই কোনাে একটি মৌলের একটি আইসােটোপ স্থিতিশীল হতে পারে আবার সেই মৌলের অন্য একটি আইসােটোপ অস্থিতিশীল বা তেজস্ক্রিয় হতে পারে।
কার্বনে মৌলের নিউক্লিয়াসে কতটি প্রোটন ও আইসোটোপ থাকে?
কার্বন মৌলটির নিউক্লিয়াসে ছয়টি প্রােটন এবং এর তিনটি আইসােটোপ:
C12: 6টি প্রােটন এবং 6 টি নিউট্রন
c13: 6টি প্রােটন এবং 7 টি নিউট্রন
c14: 6টি প্রােটন এবং ৪ টি নিউট্রন
কার্বনের এই তিনটি আইসােটোপের মাঝে c14 অস্থিতিশীল বা তেজস্ক্রিয়।
নিউক্লিয়াস থেকে যে তিনটি প্রধান তেজস্ক্রিয় রশ্মি বের হয় সেগুলাে হচ্ছে
- আলফা,
- বিটা এবং
- গামা রশ্মি
তেজষ্ক্রিয় পদার্থ সাধারনত:
আলফা, বিটা ও গামা এই তিন ধরনের তেজষ্ক্রিয় রশ্মি বিকিরণ করতে পারে। তবে অনেক ক্ষেত্রেই পজিট্রন, নিউট্রন, নিউট্রিনো, ইত্যাদিও নির্গত হতে পারে। তেজষ্ক্রিয়তা একটি সম্পূর্ণ নিউক্লিয় ঘটনা, এর মাধ্যমে নিউক্লিয়াসের ভাঙনের ফলে একটি মৌল আরেকটি নতুন মৌলে রূপান্তরিত হয়।
নিউক্লিয় ঘটনা, তাই তেজষ্ক্রিয়তা কে চাপ, তাপ, বিদ্যুৎ বা চৌম্বক ক্ষেত্রের ন্যায় বাইরের কোন সাধারণ ভৌত প্রক্রিয়া দ্বারা এর সক্রিয়তাকে রোধ বা হ্রাস বৃদ্ধি করা যায় না। তবে অত দ্রুতবেগ নিউট্রন, বা সূর্যের অভ্যন্তরের মত তীব্র তাপমাত্রা, বা সুপারনোভা বিস্ফোরণের সময়কালীন চাপের মত চরম অবস্থায় নিউক্লিয় বিক্রিয়া ঘটান সম্ভব।
তেজস্ক্রিয়তা মৌলের অর্ধায়ু কাকে বলে?
যে সময়ে কোন তেজষ্ক্রিয় পদার্থের মোট পরমাণুর ঠিক অর্ধেক পরিমাণ ক্ষয়প্রাপ্ত হয় তাকে ঐ পদার্থের অর্ধায়ু বলে।
উদাহরণ হিসেবে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ কার্বন-১৪ -এর অর্ধায়ু ৫৭৩০ বছর। যদি শুরুতে ১০০ গ্রাম কার্বন-১৪ থাকে তা তেজস্ক্রিয়-ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ৫০ গ্রামে পরিণত হতে সময় লাগবে ৫৭৩০ বছর। উক্ত ৫০ গ্রাম একইভাবে আবার ২৫ গ্রামে পরিণত হতে সময় লাগবে আরও ৫৭৩০ বছর। এই কারণে কার্বন-১৪ এর অর্ধ-জীবন = ৫৭৩০ বছর। এইভাবে ১০০ গ্রাম তেজক্রিয় কার্বন -১৪ সম্পুর্ণরূপে ক্ষয়প্রাপ্ত হতে (বাস্তবে C-14 থেকে N-14 এ পরিণত হতে) সময় লাগবে ৫১৫৭০ বছর।
একক : তেজস্ক্রিয়তার এস, আই একক বেকেরেল (Bq)।
প্রতি সেকেন্ডে একটি তেজস্ক্রিয় ভাঙ্গন বা ক্ষয়কে এক বেকেরেল বলে।
1 Bq = 1 decays-1 আগে কুরী (Ci) নামে তেজস্ক্রিয়তার একটি একক ব্যবহৃত হতাে। 1Ci = 3.7 x 10l0 decay s-1 = 3.7 x 1010 Bq.. |
তেজস্ক্রিয়তা একটি নিউক্লিয়ার ঘটনা
তেজস্ক্রিয় মৌল থেকে তেজস্ক্রিয় রশ্মি নির্গমনের ফলে আদি মৌলের নিউক্লিয়াস একটি নতুন মৌলের নিউক্লিয়াসে রূপান্তরিত হয়। তেজস্ক্রিয় রশ্মিসমূহ নিউক্লিয়াস থেকেই নির্গত হয়ে মৌলের রূপান্তর ঘটায়, তাই তেজস্ক্রিয়তা একটি নিউক্লিয়ার ঘটনা।
তেজস্ক্রিয় পদার্থের প্রকারভেদ।
তেজঞ্জির পদার্থ দু ধরনের।
যেমন:
- প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয় পদার্থ (Natural radioactive substance)
- কৃত্রিম তেজস্ক্রিয় পদার্থ (Artificial radioactive substance)
প্রাকৃতিক তেজক্রিয় পদার্থ কাকে বলে?
কোনাে প্রাকৃতিক পদার্থ হতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তেজস্ক্রিয় রশ্মি নির্গমনের ঘটনা ঘটলে সেসব পদার্থকে প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয় পদার্থ বলে।
যেমন:
- ইউরেনিয়াম (U),
- রেডিয়াম (Ra),
- থােরিয়াম (38Th)
প্রভৃতি মৌল হতে যে তেজস্ক্রিয়তা ঘটে তা প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তা। এসব মৌলের পারমাণবিক সংখ্যা 82 এর চেয়ে বেশি। |
কৃত্রিম তেজস্ক্রিয় পদার্থ কাকে বলে?
কোনাে মৌলকে কৃত্রিম উপায়ে তেজস্ক্রিয় মৌলে পরিণত করলে সেসব মৌলকে কৃত্রিম তেজস্ক্রিয় মৌল বলে। কোনাে মৌলকে নিউক্লিয় বিক্রিয়ার মাধ্যমে বাইরে থেকে অতি উচ্চ বেগ সম্পন্ন কোনাে কণা দ্বারা আঘাত করলে সেটি তেজস্ক্রিয় মৌলে পরিণত হয়। এদেরকে কৃত্রিম তেজস্ক্রিয় মৌল বা রেডিও আইসােটোপ বলে।
যেমন:
- ১৭c, go ইত্যাদি।
তেজস্ক্রিয় রশ্মির প্রকারভেদ (Types of Radioactive Rays)
বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা তিন রকম তেজস্ক্রিয় রশ্মি আবিষ্কার করেন। ১৮৯৯ সালে রাদারফোর্ড এবং ১৯০০ সালে ভিলার্ডের পরীক্ষা থেকে এসব রশ্মির সন্ধান পাওয়া যায়।
তেজস্ক্রিয় রশি তিন প্রকার।
যেমন:
- আলফা রশ্মি,
- বিটা রশ্মি এবং
- গামা রশ্মি।
মাদাম কুরীর পরীক্ষা
মাদাম কুরীর পরীক্ষা : উপরোক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে। মাদাম কুরী তিন প্রকার রশ্মির অস্তিত্ব নিঃসন্দেহে প্রমাণ করেন। তিনি একটি সীসার ব্লকের সরু লম্বা ছিদ্র করে ঐ ছিদ্রে রাখলেন রেডিয়ামঘটিত তেজস্ক্রিয় পদার্থ। ছিদ্র হতে সামান্য দূরে লম্বালম্বিভাবে একটি ফটোগ্রাফিক প্লেট রাখা হলাে যাতে রশ্মি প্লেটের ওপর পড়তে পারে। তারপর। |
সমগ্র ব্যবস্থাকে আবদ্ধ করলেন একটি বায়নিরােধী প্রকোষ্ঠে এবং পাম্পের সাহায্যে ভিতরের বাতাস বের করে নিলেন এবং চৌম্বকক্ষেত্র প্রয়ােগ করলেন। ফটোগ্রাফিক প্লেট পরিস্ফুটিত করে পাওয়া গেল তিনটি। পৃথক স্থানে তিনটি দাগ। চুম্বকের প্রভাবে এক জাতের রশ্মি গেল সামান্য বেঁকে, অপরটি গেল উল্টোদিকে অপেক্ষাকৃত অধিক বেঁকে। তৃতীয়টি মােটেই বাকেনি।
চৌম্বকক্ষেত্রের অভি, কণাগুলাের গভির বাকি অভিমুখ এবং বিভিন্ন অভি থেকে সহজে বােঝা গেল প্রথম শিটি নাক আল বশি, দ্বিতীয়টি বা বিটা কাশি এবং তৃঙ্গীটি শিপে পা জলি। নিঃসরণ থেকে আরাে বােঝা গেল আলফা রশি বিটা রশির তুলনায় অধিক ভারী।
তেজস্ক্রিয়তার বৈশিষ্ট্য
✔️যে সকল মৌলের পারমাণবিক সংখ্যা 82-এর বেশি, কেবল সে সকল পরমাণু প্রাকৃতিকভাবে তেজক্রিয় হতে পারে। এর ব্যতিক্রমও আছে যেমন c তেজস্ক্রিয় মৌল।
✔️তেজস্ক্রিয় পদার্থ সাধারণত আলফা, বিটা ও গামা এই তিন প্রকারে তেজস্ক্রিয় রশি নিঃসরণ করে।
✔️তেজস্ক্রিয়তা একটি সম্পূর্ণ নিউক্লিয়ার ঘটনা এবং এর মাধ্যমে নিউক্লিয়াসের ভাঙনের ফলে একটি মৌল আর একটি নতুন মৌলে রূপান্তরিত হয়।
✔️তেজস্ক্রিয়া একটি স্বতঃস্ফূর্ত ও উদ্দেশ্যবিহীন ঘটনা এবং এটা চাপ, তাপ, বিদ্যুৎ ৰা চৌকন্দ্রের ন্যায় বাইরের কোনাে প্রক্রিয়া দ্বারা প্রভাবিত হয় না।