সাবজেক্ট রিভিউ

আর্কিটেকচার নিয়ে কেন পড়বেন: সাবজেক্ট রিভিউ

আর্কিটেকচার বিষয়ে পড়াশোনা কেমন হবে?

তোমার কি সংসদ ভবন কিংবা আইফেল টাওয়ার দেখতে খুব ভাল লাগে? স্থাপত্যগুলোর নকশাশৈলী তোমাকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে? তাহলে বলব আর্কিটেকচার এ অধ্যয়ন এর জন্য ছোট একটি উপকরণ তোমার মধ্যে রয়েছে। কিন্তু আর্কিটেকচার এর পরিসর কিন্তু কেবল স্থাপত্যশৈলীতেই কিংবা সহজ ভাষায় বিল্ডিং ডিজাইন এই সীমাবদ্ধ নয়৷ অনেকে আর্কিটেকচার কে প্রকৌশল এর অংশ, এক কথায় অন্তর্ভুক্তই বলে মনে করে। এমন ভাবাটাই স্বাভাবিক কারণ জব সেক্টর এবং কোর্স স্ট্রাকচার দুটোই ইঞ্জিনিয়ারিং এর সাথে যেন মিলেমিশে আছে।

কিন্তু মজার ব্যাপার হল এটা আসলে ফাইন আর্টসের একটা স্ট্রিম। আর্কিটেকচার আসলে প্রকৌশল নয়, আবার কোনো ধরা-বাঁধা কোনো সাবজেক্টও নয়। তাহলে আর্কিটেকচার বা স্থাপত্য আসলে কি? এই প্রশ্নের মনমতো জবাব আসলে ১০ বছর পড়ার পরও কেউ বলতে পারে না। আর্কিটেকচার একটা পরিপূর্ণ জীবনধারা। একজন আর্কিটেক্ট এর নিজস্ব ব্যাপারটা খুব বেশি কাজ করে। কাউকে অনুকরণ করে দেখে তারা কিছু করে না। যেমন, ফ্র‍্যাংক লয়ড রাইট তার বাসার যাবতীয় জিনিসপত্র নিজে ডিজাইন করেন। বাজার থেকে জিনিস কিনে ঘর সাজানো আর নিজে ডিজাইন করে নিজের ঘর সাজানোর মধ্যে কতটা তফাৎ তা হয়তো নিজে না করে দেখলে বোঝা সম্ভব নয়!

আর্কিটেকচার শুধু বিল্ডিং ডিজাইন করা শেখায় না। শেখায় মানুষ, প্রকৃতি ও জীবনকে উপলব্ধি করতে। এক কথায়, সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে শেখায় স্থাপত্যবিদ্যা।
অনেকের ধারণা ভাল আঁকতে পারলেই বুঝি ভাল আর্কিটেক্ট হওয়া যায়। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা আমি এটাও বলব না। ড্রইং এর স্কিল থাকা খুবই ভাল। আসলে না পারলেও কোনো সমস্যা হয়না তা আমি কোনো ডাউট ছাড়াই বলতে পারি।

আর্কিটেকচার সাবজেক্ট রিভিউ

 

See also  সাইকোলজি বা মনোবিজ্ঞান নিয়ে কেন পড়বেন : সাবজেক্ট রিভিউ

আর্কিটেকচার পড়তে কী কী লাগে?

অসীম ইচ্ছা, পরিশ্রমী মানসিকতা, অ্যাম্বিশান, নিজেকে প্রকাশ করার ইচ্ছা ও প্রবণতা এবং সর্বোপরি,”I CANNOT GIVE UP” মেন্টালিটি। আর্কিটেকচার এ গ্র‍্যাজুয়েশন কমপ্লিট করা অনেক বেশিই চ্যালেঞ্জিং। অল্পতে তুষ্ট না হওয়া কিংবা “Think out of the box” মানসিকতা ছাড়া ভাল আর্কিটেক্ট হওয়া অসম্ভব। অন্যান্য ইঞ্জিনিয়ারিং সাব্জেক্ট এর শিক্ষার্থীরা যেখানে ৪ বছরে কোর্স শেষ করে সেখানে আর্কিটেকচার এ লাগে ৫ বছর।

সুতরাং বুঝতেই পারছ “ধৈর্য্য” থাকাটা খুব জরুরি। অল্প সময়েই অমানুষিক চাপ নিতে হয়। “প্যারা নাই,চিল” বাক্যটি আর্কিটেকচার এ পড়া যেকোনো শিক্ষার্থীর জন্য পরিচিত লাইন। অনেক চাপের মাঝে এই কিছু শব্দই অনুপ্রেরণা দেয়।

 

আর্কিটেকচার কোর্সে কী কী থাকে?

৫ বছরের আন্ডারগ্র্যাড কোর্স আর এক বছরের ইন্টার্নশিপ। ৫ বছরে প্রায় ২০০ ক্রেডিট এর কোর্সে ইতিহাস,সাইকোলজি থেকে শুরু করে ইলেক্ট্রিক্যাল, মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং সবই থাকে। ১.৫ ক্রেডিট এর একটা গানের কোর্সও থাকে। কোর্সের বিশাল অংশজুড়ে থাকে ডিজাইন। ফার্স্ট ইয়ার ৪ ক্রেডিট এর হলেও ৫ বছরে তা বেড়ে হয় ১০-১২ ক্রেডিট এর৷ ফিজিক্স ম্যাথ এ ক্রেডিট কম হলেও তা থিওরির একটা বড় অংশজুড়ে আছে।

 

বাংলাদেশের কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্কিটেকচার পড়ানো হয়?

বুয়েট, চুয়েট, কুয়েট, রুয়েট, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, এম আই এস টি, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, এআইইউবি, আহসানুল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটি, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ব্র‍্যাক ইউনিভার্সিটিতে পড়ানো হয় আর্কিটেকচার।

 

আর্কিটেকচারে ভালো করতে হলে উচ্চ মাধ্যমিকের কোন কোন বিষয়ে দক্ষ হতে হয়?

আর্কিটেকচারের এডমিশন টেস্ট ২ ধাপে সম্পন্ন হয়। প্রথমত অন্যান্য ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়গুলো মত ৬০০ মার্কসের পরীক্ষা দিতে হয়(পদার্থবিজ্ঞান + রসায়ন + গণিত)। তাই অবশ্যই পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নে এবং গণিতে যথেষ্ট পরিমাণ দক্ষতা থাকতে হবে। এছাড়া দ্বিতীয়ত শুধু আর্কিটেকচারের জন্য এক্সট্রা ৪০০ মার্কসের ড্রয়িং এক্সাম দিতে হয়। তাই এডমিশন এর পূর্বে ৪,৫ মাস যদি ড্রয়িং প্র‍্যাক্টিস করা হয় তাহলে ভালো করা যায়।

See also  বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি নিয়ে কেন পড়বেন?

 

পড়ালেখার ধরণ কেমন হয়?

আর্কিটেকচারের পড়াশোনায় তাত্ত্বিক ও ব্যবহরিক দুটোই সমান গুরুত্বের সাথে পড়ানো হয়। তবে কোর্সের বিশাল একটি অংশ যেহেতু ডিজাইন এর উপর থাকে তাই ব্যবহারিক অংশকে আমি বেশী প্রাধান্য দিব।

 

এই বিষয়ে অধ্যয়নকালীন কী কী এক্সট্রা কারিকুলাম এক্টিভিটি তে যুক্ত থাকা যায় যা পরবর্তীতে আমাদের ক্যারিয়ার গঠনে হেল্প করবে?

ভবিষ্যতে ক্লায়েন্টদের সাথে ভালো যোগাযোগ রক্ষার্থে নিজের ভালো কমিউনিকেশন স্কিল থাকা খুবই জরুরি। তাই এই সময়ে ডিবেট ক্লাব, কালচারাল ক্লাব গুলোতে যুক্ত থাকলে ভবিষ্যতে ভালো ফিডব্যাক পাওয়া যাবে।

অনার্সে অধ্যয়নরত অবস্থায় ইইন্টার্নশিপের সুযোগ কেমন?

এক্ষেত্রে অনার্স ৪র্থ বর্ষে বিভিন্ন আর্কিটেকচারাল ফার্মে ইন্টার্ন করার সুযোগ পাওয়া যায়। ফলে ডিজাইন, গ্রাফিক্স এবং অন্যান্য প্র‍্যাক্টিক্যাল কোর্সগুলো হাতে-কলমে আরো সুন্দরভাবে শেখা যায়।

 

আর্কিটেকচার পড়াশোনা শেষে চাকরির সুযোগ কেমন?

জব সেক্টর নিয়ে যদি বলি একজন আর্কিটেক্ট এর পাস করার পর দুইটি পথ খোলা থাকে হয় সে একাডেমিক লাইনে বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি এর লেকচারার হিসেবে জয়েন করতে পারে অথবা কর্পোরেট কোনো আর্কিটেকচার ফার্ম কিংবা কন্সট্রাকশন কোম্পানির সাথে কাজ করতে পারে।

গভমেন্ট লেভেল এ জব সেক্টর এখন তৈরি হচ্ছে যেমন, স্থাপত্য অধিদপ্তর, রাজউক বা সিটি কর্পোরেশন কিংবা ওয়ার্ল্ড ব্যাংক বা এডিবির ফান্ডিং এ যে প্রোজেক্টগুলো হয় সেখানে আর্কিটেক্টদের বিরাট একটা রোল প্লে করার সুযোগ রয়েছে।

 

চাকুরি ক্ষেত্রে স্যালারি রেঞ্জ কেমন?

স্যালারি মূলত নির্ভর করে অ্যাপ্লিকেন্ট এর জব প্রোফাইল, কোম্পানি, লোকেশন এবং কাজের অভিজ্ঞতার উপর। “না খেয়ে মরতে হবে” এই ধারণা কিন্তু একদমই ভুল। একজন আর্কিটেক্ট এর বার্ষিক সম্মানি প্রায় ৪ লক্ষ থেকে ৫ লক্ষ টাকা।

See also  অর্থনীতি নিয়ে কেন পড়বেন : সাবজেক্ট রিভিউ

যেসব আর্কিটেক্ট এর ৫ বছরের অভিজ্ঞতা আছে তারা প্রতি বছর ৮ থেকে ১০ লক্ষ টাকা আয় করতে পারে। সরকারি কাজের ক্ষেত্রে স্যালারি কম্পারেটিভলি বেশি। বেশিরভাগ আর্কিটেক্ট ফুল টাইম কন্সালটেন্সি প্রেফার করে অধিক আয়ের উদ্দেশ্যে।

 

পড়াশোন শেষে বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ কেমন?

ব্যাচেলর ডিগ্রি এর পর সাধারণত শিক্ষার্থীরা মাস্টার্স ইন আর্কিটেকচার ডিগ্রি/ M.Arch অর্জন এর উদ্দেশ্য নিয়ে বিদেশের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিগুলোতে আবেদন করে।মূলত তিনটি স্ট্রিমের উপর তারা মাস্টার্স করে M.arch (Masters of Architecture), MLA (Masters in Landscape Architecture), MUD (Masters in Urban Design)। মেধা ও ভাল সিজিপিএ এর ভিত্তিতে ইউনিভার্সিটিগুলোতে শিক্ষার্থীদের রিক্রুট করা হয়৷

মাস্টার্স ইন আর্কিটেকচার ছাড়াও শিক্ষার্থীরা আরো অন্যান্য বিষয়ে যেমন এমএসসি ইন আর্কিটেকচারাল লাইটনিং ডিজাইনিং, এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন, এমপ্ল্যান ইত্যাদি বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন এর সু্যোগ আছে।

এছাড়াও পিএইচডি ডিগ্রি এবং পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চ করার জন্যও নিজের মেধাকে যাচাই করে নিতে পারে। মূলত আন্ডারগ্র্যাড এর ৫ বছরে কে কতটা সুন্দরভাবে প্রোজেক্ট এবং ডিজাইন এর কাজগুলো করেছে সেটার উপরই নির্ভর করে বিদেশে উচ্চশিক্ষার স্কলারশিপ।

 

জুনিয়রদের উদ্দ্যেশ্যে কিছু কথা

আর্কিটেকচার খুব চ্যালেঞ্জিং হলেও ৫ বছরের ব্যথা আর আনন্দে ভরা জীবন তোমার সবসময় মনে থাকবে। “আমি আর্কিটেকচার এই পড়তে চাই” ব্যাপারটা নাহ থাকলে ৫ বছর তোমার কাছে বিভীষিকাময় মনে হবে। এখানে বন্ধুরা পরিবার হয়ে ওঠে, জীবন হয়ে ওঠে প্রোজেক্টময়, জীবনের খুব কঠিন বিষয়ও সহজ মনে হওয়া শুরু হয়। সৃষ্টির মানে খুঁজে পাওয়া যায়। এটাই শান্তি, এটাই উৎসাহ। আর্কিটেকচার শুধু তাদের জন্যই যারা এই জীবন চায়!

Related Articles

Back to top button