শিক্ষককে নিয়ে স্মৃতিচারন
প্রিয় পাঠক, ছোটবেলায় আমরা প্রাইমারি স্কুলে পড়াশোনা করেছি। এরপরে আমরা হাই স্কুল এবং কলেজ এর পাশাপাশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছি। তো এই লেখাপড়া করার মুহূর্তে আমাদের বিভিন্ন শিক্ষক সঠিক সময়ে সঠিক শিক্ষা দিয়েছেন। যার ফলে আমরা আজকে এতদূর পর্যন্ত আসতে পেরেছি। আর যখন আমরা এই শিক্ষা জীবনের মধ্যে ছিলাম। তখন আমাদের প্রত্যেকের এক বা একাধিক শিক্ষক থাকবে। যাদের কথা আমাদের সারা টি জীবন মনে থাকবে। যদিও বা সকল শিক্ষক হলো মানুষ গড়ার হাতিয়ার। কিন্তু সেই শিক্ষক নামক হাতিয়ারের মধ্যে এমন কিছু শিক্ষক থাকে। যাদের অবদান কখনোই ভুলে যাওয়ার মত নয়। আর আজকে আমি মূলত আমার জীবনের এমন কিছু শিক্ষককে নিয়ে স্মৃতিচারণ লিখব। যে শিক্ষকদের কথা আমি কোনদিনও ভুলতে পারবো না।
তবে শুধুমাত্র আমার জীবনে প্রিয় শিক্ষক আছে বিষয় টা এমন নয়। বরং আপনার জীবনেও এমন শিক্ষক থাকবে। যাকে আপনি সারাটি জীবন শ্রদ্ধা করে স্মরণ করবেন। আর যদি আপনার এমন শিক্ষক থেকে থাকে। তাহলে অবশ্যই আপনার শিক্ষককে নিয়ে স্মৃতিচারন লিখে ফেলুন। এবং আপনার সেই লেখা টা আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিন। যদি আপনার লেখার মধ্যে শিক্ষকের প্রতি মাধুর্য তা থাকে। তাহলে অবশ্যই আমরা আপনার সেই শিক্ষককে নিয়ে স্মৃতিচারণ টি এই ওয়েবসাইটের মধ্যে পাবলিশ করব। তো আর দেরি না করে চলুন আমার জীবনে সেই প্রিয় শিক্ষককে নিয়ে স্মৃতিচারণ সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
শিক্ষককে নিয়ে স্মৃতিচারণ (পার্ট-১)
বরাবরের মতো আমি অনেক অলস একজন ব্যক্তি। সে কারণে সকালে উঠতে আমার একটু দেরি হয়। কিন্তু সকালে উঠে দেখি আমার বন্ধু রবিন আমাকে বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছে। আমি জানি রবিন অনেক ব্যস্ত একজন মানুষ। কিন্তু তার ফোন থেকে আসা মিসড কল গুলো দেখার পরে আমি বেশ চিন্তিত হয়ে গেলাম। আর তারপরেই তাকে কল দিলাম। কিন্তু যখন তাকে কল দিলাম, তখন সে সরাসরি বলে উঠলো যে, “তুই কি কিছু শুনেছিস”?- আমি তার কথা শোনার পরে বললাম, “কই না তো! আমি আবার কি শুনবো”? -আর এই কথা টি বলার সাথে সাথে রবিন বলে উঠলো যে। আমার প্রিয় স্যার নাকি তার শিক্ষা জীবন থেকে অবসর নিয়েছেন। আর যখন রবিন আমাকে এই কথাটি বলল। তখন সে আরো বললো যে, “তোর তো অনেক প্রিয় স্যার, তিনি তো আজ অবসর নিলেন।”
যখন রবিন আমাকে এই কথা গুলো বলল। তখন আমি রবিন কে বলে উঠলাম যে, “স্যার কি শুধু আমার প্রিয় ছিল? এই স্যার তো গোটা স্কুলের একজন প্রিয় মানুষ ছিল”। আর সেই মানুষ টি আজকে অবসর নিচ্ছে। বিষয়টা সত্যি বেদনা দায়ক। যখন রবিন আমাকে স্যারের অবসর নেওয়ার কথা গুলো বলছিল। তখন কেমন জানি একটা অনুভব হচ্ছিল। যখন আমি সেই স্যারের ক্লাস করেছিলাম। তখন স্যার আমাকে যে কত মারতো, যা আসলে হিসেব করা সম্ভব না। হয়তো কোনদিন ক্লাসে পড়া দিতে পারিনি, সে কারণে স্যারের হাতে মার খেয়েছি। আবার এমন অনেক দিন রয়েছে যে দিন গুলো তে বন্ধুদের সাথে ফাজলামো করার কারণে। সেই স্যারের হাতে প্রচুর পরিমাণে মার খেয়েছিলাম।
একটা কথা বলে রাখা ভালো। যখন আমি ছোট ছিলাম তখন পড়ালেখার দিক থেকে আমি অনেকটাই ফাঁকিবাজ ছিলাম। আর আমাদের স্কুলের জগদীশ স্যার পড়াশুনায় ফাঁকিবাজি একদম পছন্দ করত না। যদি এমন ফাঁকিবাজি দেখতে পেত। তাহলে স্যার তাদের কে উত্তম মাধ্যম দিত। আর সে কারণেই ছোট বেলায় সেই স্যার কে খুব একটা ভালো লাগতো না। আমার কারণ যেহেতু আমি ফাঁকিবাজ ছিলাম। সেহেতু প্রায় সেই জগদীশ স্যারের হাতে মার খেতাম। তবে এই জগদীশ স্যার এর বিশেষ একটা গুন ছিল। তিনি যখন কোন ছাত্র কে শাস্তি দিতেন। তারপরে সেই ছাত্রের গায়ে হাত বুলিয়ে বোঝাতেন যে। এসব করা ঠিক না বরং ঠিকভাবে লেখাপড়া করতে হবে। না হলে আমরা মানুষের মতো মানুষ হতে পারব না।
শিক্ষককে নিয়ে স্মৃতিচারণ (পার্ট-২)
বিষয় টা দুঃখজনক হলেও সত্য যে, স্কুলে থাকা অবস্থায় এই জগদীশ স্যারের কাছে মাত্র দুই বছর পড়াশোনা করার সুযোগ হয়েছিল। আর এই দুই বছরে আমি এই শিক্ষকের কাছে এতকিছু জ্ঞান অর্জন করতে পেরেছি। যার ফলে আজকে আমি নিজে কে অনেকটা ভাগ্যবান মনে করি। সত্যি বলতে তিনি আমার জীবনের এমন একজন শিক্ষক। যাকে সারাটা জীবন শ্রদ্ধা করলেও তার প্রতি কখনোই এই শ্রদ্ধা কমবে না। তিনি হলেন শিক্ষকের আদর্শ, তিনি হলেন মানুষ গড়ার সত্যিকারের হাতিয়ার। তিনি শুধুমাত্র আমার হৃদয়ে এমন ছাপ ফেলতে পারেননি। বরং যতদিন তিনি সেই স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। ততদিন তিনি হাজার হাজার ছাত্রদের হৃদয়ের জায়গা করে নিয়েছেন। আর তার মত শিক্ষকের হাত ধরে অনেক শিক্ষার্থী আজকে মানুষের মতো মানুষ হতে পেরেছে।
শিক্ষা জীবনে এই জগদীশ স্যার আমাদের স্কুলে গণিত বিষয়ে পড়াশোনা করাতেন। তিনি এই গণিত বিষয়ে শুধুমাত্র একজন শিক্ষক ছিলেন না। বরং আমাদের কাছে তিনি ছিলেন স্বয়ং একজন গাইড বই। কেননা স্কুলে থাকা অবস্থায় যখন আমরা কোন অংক করতে পারতাম না। তখন সেই স্যার কে অংকের শুরু টা বলার সাথে সাথে গোটা অংকের উত্তর টা তিনি ব্ল্যাক বোর্ডে করে দিতেন। আর এটা দেখে আমরা সত্যিই অনেক অবাক হয়ে যেতাম। আর সবাই মনে মনে ভাবতাম যে, স্যার এত কিছু কিভাবে মনে রাখে। তবে তিনি যখন আমাদের অংক বোঝাতেন। তখন যদি আমরা ক্লাসের মধ্যে টুকটাক কথা বলতাম। তাহলে জগদীশ স্যার রেগে একবারে আগুন হয়ে যেত। সেই দিন গুলোর কথা মনে পড়লে এখনো আমার হাসি পায়।
আর যেহেতু আমি লেখাপড়ায় অনেক ফাঁকিবাজ ছিলাম। সেহেতু ক্লাসের অনেকেই আমাকে বলতো যে। আমি কোনদিন অংকে পাস করতে পারবো না। কিন্তু এই জগদীশ স্যার আমাকে এমন ভাবে বইয়ের মধ্যে থাকা অংক গুলো কে শিখিয়েছিল যে। আমি সেই বছরে অন্যান্য সাবজেক্ট এর তুলনায় অংকের মধ্যে অনেক ভালো মার্কস তুলতে পারি। আর আমার এই ফলাফল দেখে আমার সহপাঠী বন্ধুরা একেবারে অবাক হয়ে গিয়েছিল। তবে সেদিনের সফলতার জন্য আমার প্রিয় জগদীশ স্যারের অশেষ অবদান ছিল। কেননা তিনি আমাকে খুব যত্ন সহকারে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। হয়তো সেদিন যদি জগদীশ স্যার না থাকতো। তাহলে আমি কোন ভাবেই সেই বছরের এসএসসি পরীক্ষা তে পাশ করতে পারতাম না।
শিক্ষককে নিয়ে স্মৃতিচারণ (পার্ট-৩)
যখন রবিনের ফোনের মাধ্যমে আমি জানতে পারি যে আমার প্রিয় জগদীশ স্যার আজকে অবসর নিচ্ছে। তখন আর নিজেকে আটকে রাখতে পারিনি। বরং নিজের শত ব্যস্ততার পরেও আমি ছুটে গিয়েছিলাম সেই স্কুলের মাঠে। আর যখন স্কুলের মাঠে গিয়ে পৌঁছাই। তখন দেখি বেশ বড়সড় আয়োজন করা হয়েছে। মাঠের একপাশে তৈরি করা স্টেজের মধ্যে চেয়ারে বসে আছেন আমার প্রিয় জগদীশ স্যার। মাঠের মধ্যে তার এই অবসর কে ঘিরেই চলছে বিভিন্ন রকমের আয়োজন। একে একে অনেক ছাত্র ছাত্রীরা সেই স্যারের বিদায় উপলক্ষে নিজের বক্তব্য পেশ করছে। আমি ভিরের মধ্যে থেকে একটু সামনে যাওয়ার চেষ্টা করলাম।
আর যখন সামনে যাই তখন দেখতে পাই যে, সেই রাগী জগদীশ স্যারের চোখ আজ কোন রাগ নেই। বরং আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আজ জগদীশ স্যারের দুই চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। তিনি স্কুলের চারপাশ টা নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছেন। হয়তো অতীতের দিনের স্মৃতি গুলো তাকে কোনো ভাবেই ছেড়ে যেতে চাইছে না। হয়তো শত শত ছাত্র ছাত্রীদের ভিড়ে আমি সবার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেও। স্যার সেদিন আমাকে ঠিক মতো দেখতে পারেনি। কিন্তু আমি স্যার কে ঠিকই দেখতে পাচ্ছি। তিনি চেয়ারে বসে এপাশ ওপাশ তাকাচ্ছেন। আর রুমাল দিয়ে ঘনঘন নিজের চোখ দুটো মুছছেন।