আইন আদালত

ম্যাজিস্ট্রেট এবং বিচারকের মধ্যে পার্থক্য

ম্যাজিস্ট্রেট বনাম নির্বাহী কর্মকর্তা বিসিএস

ম্যাজিস্ট্রেট নামে বিসিএসে কোন ক্যাডার নেই। বিসিএস (প্রশাসন)-এ যারা নিয়োগ পান, তারা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার হিসেবে জয়েন করেন। প্রশাসনিক কাজই তাদের মূল কাজ এবং তাদের পদবী হল সহকারী কমিশনার (প্রশাসন), ম্যাজিস্ট্রেট নয়। তবে Cr PC এর ধারা ১০(৫) অনুযায়ী সরকার চাইলে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদেরকে সীমিত আকারে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা অর্পণ করতে পারেন। তাদেরকে তখন বলা হয় “নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট” (not magistrate)।

Section 10(5) হুবহু – “The Government may, if it thinks expedient or necessary, appoint any persons employed in the Bangladesh Civil Service (Administration) to be an Executive Magistrate and confer the powers of an Executive Magistrate on any such member.”

Executive Magistrate মূল পদ নয় বরং Delegated duty. প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য (এ ধারায় লেখা হয়েছে The Government may… ) আইনে Shall এবং May শব্দ দুটির মাঝে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। যখন “may” শব্দটি ব্যবহৃত হয়, তখন সেই কাজটি ঐচ্ছিক হিসেবে গণ্য হয়। “Shall” ব্যবহৃত হলে কাজটি করা বাধ্যতামূলক হয়ে যায়।

সুতরাং প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদেরকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিতে সরকার বাধ্য নয়। Executive Magistrate সর্বোচ্চ ২ বছরের কারাদণ্ড যোগ্য অপরাধের বিচার করতে পারেন। এই বিচারের শর্ত হল উক্ত অপরাধমূলক কাজ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে সংঘটিত বা উদঘাটিত হতে হবে + অভিযুক্ত কর্তৃক তার কৃত অপরাধ লিখিতভাবে স্বীকার করতে হবে।

তা না হলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাকে কোন দণ্ড দিতে পারবেন না, সেক্ষেত্রে তিনি অভিযুক্তকে পুলিশের মাধ্যমে আদালতে চালান করবেন। (ধারা-৬, ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন, ২০০৯)। প্রশাসনিক কর্মাকর্তা কর্তৃক ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা ইতিমধ্যে হাইকোর্ট বিভাগ অবৈধ ঘোষণা করেছে। বর্তমানে এই রায়ের বিরুদ্ধে অ্যাপিলেট বিভাগে আপিল পেন্ডিং রয়েছে।

অ্যাপিলেট ডিভিশন হাইকোর্ট ডিভিশনের রায় বহাল রাখলে পার্লামেন্ট ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন সংশোধন করতে বাধ্য হবে। এরপর নির্বাহী অফিসার কর্তৃক ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা যাবে না এবং এ স্থলে জুডিশিয়াল অফিসার কর্তৃক ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হবে। তবে যতদিন এ রায় না হচ্ছে, তততিন নির্বাহী অফিসার কর্তৃক ভ্রাম্যমাণ আদালত চলতে বাঁধা নেই। তবে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মূল কাজ হল- লাইসেন্স প্রদান, লাইসেন্স বাতিলকরণ, প্রসিকিউশন অনুমোদন বা প্রত্যাহারকরণ ইত্যাদি যেসব কাজের প্রকৃতি প্রশাসনিক বা নির্বাহী ধরণের তা সম্পাদন করা।

See also  আমলাতন্ত্র কাকে বলে, প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য এবং আমলাতন্ত্রের কার্যাবলী সম্পর্কে বিস্তারিত

২০০৭ সালের নভেম্বরে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক হওয়ার পর বাংলাদেশে দুই ধরনের ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছে। এক, বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট (জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট) এবং দুই, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ আদতে বিচারের সাথে সম্পর্কিত নয় যেমন- উচ্ছেদ অভিযান, পাবলিক পরীক্ষা সম্পর্কিত কিছু দায়িত্ব, বি.আর.টি.এ -তে লাইসেন্স করণ ইত্যাদি সহ এরুপ কাজের জন্য আইনে এ্যাসাইন্ড থাকার জন্য মূলত দায়িত্বপ্রাপ্ত। তবে, নির্বাহী বিভাগের দাবীর প্রেক্ষিতে সরকার মোবাইল কোর্ট আইনের মাধ্যমে তাদেরকে কিছু ক্ষেত্রে বিচারিক ক্ষমতাও দিয়েছে।

বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটগণ অন্যদিকে বিচার সম্পর্কিয় কাজের সাথে যুক্ত। কোন আসামীকে পুলিশ ধরে আনলে প্রথমে তাদেরকে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের সামনে উপস্থাপন করে। এরপর আসামীর রিমান্ড, ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৪ ধারার জবানবন্দী প্রদান, নারী ও শিশু মামলায় ভিকটিমের জবানবন্দী গ্রহণ, ভিকটিমকে জিম্মা প্রদান সহ অন্যান্য কাজ বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটগণ করে থাকেন।

পাশাপাশি পুলিশ কোন মামলায় চার্জশীট দিলে সেগুলো প্রথমে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের কাছে উপস্থাপন করা হয়। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবরা এরপর দেখেন মামলাটি কোন বিচারক দ্বারা বিচার্য। আইন অনুযায়ী তিনি পরে মামলাগুলোর কতক দায়রা জজ সাহেবের কাছে প্রেরণ করেন এবং কতক চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের নির্দেশে নিজেরা বিচার করেন।

জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এর কাজ কি?

(ধারা- ৪(২) (খ) শুধুমাত্র “ম্যাজিস্ট্রেট” বলতে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে বুঝায়। Cr PC এর ধারা 4A(a) তে বলা হয়েছে, “without any qualifying word, to a Magistrate, shall be construed as a reference to a Judicial Magistrate.” অর্থাৎ কেউ যদি বলেন “আমি ম্যাজিস্ট্রেট।” এর অর্থ হল উনি জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট।

কোন এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট নিজেকে শুধুমাত্র “ম্যাজিস্ট্রেট” হিসেবে পরিচয় দিতে পারেন না। জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের মূল কাজ বিচার করা।

 

আরো বিস্তর আলোচনা করতে গেলে বলতে হয় সরকারের বিভাগ তিনটি-

১) আইন বিভাগ– বাংলাদেশে এই বিভাগ MP (সংসদ সদস্য) -দের নিয়ে গঠিত। তাদের কাজ হল আইন তৈরী করা।

২) নির্বাহী বা শাসন বিভাগ – রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ সকল মন্ত্রী, সচিব, বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া ও অন্যান্যভাবে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে শাসন বা নির্বাহী বিভাগ গঠিত। আইন অনুযায়ী শাসন কাজ চালনা করাই হল শাসন বিভাগের কাজ। তাছাড়া শাসন বিভাগ বিচার বিভাগ কর্তৃক প্রদত্ত রায় বাস্তবায়ন করে থাকে।

See also  এডভোকেট নাকি ব্যারিস্টার?

৩) বিচার বিভাগ– সুপ্রিম কোর্ট (হাইকোর্ট ডিভিশন ও অ্যাপিলেট ডিভিশন) এবং নিম্ন আদালত ও বিভিন্ন ট্রাইবুনালের সমন্বয়ে বিচার বিভাগ গঠিত।আইন বিভাগ যে আইন প্রনয়ন করে, সে আইন অনুযায়ী বিচার করাই হল বিচার বিভাগের মূল কাজ।

যারা বিচার করেন তাদেরকে বিচারপতি (সুপ্রিম কোর্টের বিচারক) , জজ ও ম্যাজিস্ট্রেট (প্রতি জেলায় নিম্ন আদালতের বা ট্রাইবুনালের বিচারক) বলা হয়। বিচার বিভাগ হল সংবিধানের অভিভাবক। সংবিধানকে পাশ কাটিয়ে আইন বিভাগ কোন আইন তৈরী করলে কিংবা অন্য কোন আইনের সাথে বিরোধপূর্ণ আইন তৈরী করলে কিংবা নির্বাহী বিভাগ উল্টাপাল্টা কাজ করলে বিচার বিভাগ জুডিশিয়াল রিভিউ কিংবা রিট এখতিয়ার প্রয়োগের মাধ্যমে আইন বিভাগ কর্তৃক প্রণীত কোন আইন বা নির্বাহী বিভাগ কর্তৃক কৃত যেকোন কাজকে বাতিল ও অকার্যকর ঘোষণা করে আদেশ দিতে পারেন।

আইনের ব্যাখ্যা দেবার দায়িত্বও বিচার বিভাগের হাতে ন্যস্ত।শাসন বিভাগের বিভিন্ন উপবিভাগের মধ্যে অন্যতম হল প্রশাসন (Public Administration)।

বিসিএসের মাধ্যমে যেসব মেধাবী ও সৌভাগ্যবান ব্যক্তিরা প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে জয়েন করেন, তাদের পদবি হল- সহকারী কমিশনার (প্রশাসন)। ম্যাজিস্ট্রেট নয়। পুলিশের ASP পদমর্যাদার ব্যক্তিদেরকে কিংবা Board examination ও বিভিন্ন পরীক্ষায় দায়িত্ব পালনের সময় সরকারি কলেজের শিক্ষকদেরকেও (বিসিএস- শিক্ষা ক্যাডার) সরকার ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা অর্পণ করতে পারেন। যাকে স্পেশাল এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট বলে। তবে তারা কিন্তু নিজেদেরকে ম্যাজিস্ট্রেট পরিচয় দেন না।

যখন বলা হচ্ছে,”অমুক ভাই একজন ম্যাজিস্ট্রেট।” তার অর্থ – অমুক ভাই হলেন বিচার বিভাগে নিযুক্ত একজন বিচারক। যার বেতন স্কেল শুরুতে ৬ষ্ঠ গ্রেড (ব্যাসিক ৩০,৯৩৫ টাকা)। আর যিনি বিসিএসের মাধ্যমে সহকারী কমিশনার (প্রশাসন) হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন, তার বেতন স্কেল শুরুতে ৯ম গ্রেড (ব্যাসিক ২২,০০০ টাকা)।

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এর কাজ কি?

কোন সহকারী কমিশনার (প্রশাসন)-কে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে পরিচয় দিতে হলে অবশ্যই অবশ্যই এবং অবশ্যই বলতে হবে তিনি “নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা Executive Magistrate”। শুধুমাত্র ” ম্যাজিস্ট্রেট” বলা যাবে না। প্রশাসনের কোন সহকারী কমিশনার যখন ভূমি অফিসের দায়িত্ব পালন করেন, তখন তাকে বলা হয় Assistant Commissioner of Land (প্রচলিত AC Land)।

এরপর সহকারী কমিশনারগণ প্রমোশন পেতে পেতে উপজেলা নির্বাহি অফিসার (UNO- UNO, DC উনাদেরও কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা আছে। অথচ লোকে তাদেরকে ম্যাজিস্ট্রেট বলে না৷বরং সদ্য জয়েন করা সহকারী কমিশনার (প্রশাসন)-কে ম্যাজিস্ট্রেট বলে ভুল করেন), অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (ADC), জেলা প্রশাসক (DC), অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার, বিভাগীয় কমিশনার, মন্ত্রণালয়ের সচিব ইত্যাদি পদ অর্জন করেন। বলা বাহুল্য প্রশাসনের সর্বোচ্চ নির্বাহী অফিসার হলেন সচিব এবং মন্ত্রণালয়ের প্রধান হলেন মন্ত্রী।

See also  আমলাতন্ত্র কাকে বলে, প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য এবং আমলাতন্ত্রের কার্যাবলী সম্পর্কে বিস্তারিত

সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত সচিব হয়ে বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসক হয়ে UNO এবং সহকারী কমিশনারের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়িত হয়।
প্রশাসনিক কর্মকর্তাগণ নিঃসন্দেহে সরকারের অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন। আবার, একটি জেলার সর্বোচ্চ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে বলা হয় ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট। জেলা প্রশাসকের উপরে সরকার ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেসির দায়িত্ব অর্পণ করে।

কখনো কি শুনেছেন কোন জেলা প্রশাসক নিজেকে জেলা প্রশাসক হিসেবে পরিচয় না দিয়ে শুধু ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পরিচয় দিয়েছেন? অন্যান্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট যেসব রায় দেন, তাদের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে হয় ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের (জেলা প্রশাসক) কাছে। জেলা প্রশাসকের রায়ের বিরুদ্ধে এরপর আপিল করতে হয় জেলা ও দায়রা জজের নিকটে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট প্রমোশন পেয়ে এক সময়ে জেলা ও দায়রা জজ হন। একটি জেলার সর্বোচ্চ প্রশাসনিক কর্মকর্তা যেমন জেলা প্রশাসক, তেমনি একটি জেলার সর্বোচ্চ জুডিশিয়াল অফিসার হলেন জেলা ও দায়রা জজ।

উপরের আপিল সংক্রান্ত বিষয় থেকে পরিষ্কার জেলা ও দায়রা জজের পদমর্যাদা জেলা প্রশাসকের থেকে উপরে। জেলা ও দায়রা জজের পদমর্যাদা প্রশাসনের সচিব সমমানের। যাহোক, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা ম্যাজিস্ট্রেট হতে হলে অবশ্যই আইন ব্যাকগ্রাউন্ডের হতে হবে। এরপর বিসিএসের মত করে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (BJS) পরীক্ষা দিতে হবে। সহকারী কমিশনার (প্রশাসন) যেকোন সাবজেক্টে পড়ে হওয়া যায়, তবে ম্যাজিস্ট্রেট হতে হলে অবশ্যই আইনের ডিগ্রি থাকা বাধ্যতামূলক।

ম্যাজিস্ট্রেট (জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট) এবং সহকারী কমিশনার (প্রশাসন) (এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট) সংক্রান্ত ধারণা পরিষ্কার হয়েছে আশা করি। প্রশাসনিক কর্মকর্তাদেরকে ছোট করে দেখার অভিপ্রায়ে এই লেখাটি লিখিনি, বরং প্রচলিত কিছু ভুল ধারণা দূর করতে সচেষ্ট হয়েছি। বিচার বিভাগ এবং শাসন বিভাগ সরকারের অবিচ্ছেদ্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ এবং তাদের কাজের ক্ষেত্র আলাদা। বিসিএস প্রশাসন নিঃসন্দেহে চমৎকার প্রেস্টিজিয়াস একটি চয়েস। বিসিএস প্রশাসনে সদ্য সুপারিশ প্রাপ্ত বা নিয়োগ প্রাপ্ত ব্যক্তির পদবীকে সহকারী কমিশনার (প্রশাসন) বলুন, ম্যাজিস্ট্রেট নয়।

 

Back to top button