ব্যাকরণ কাকে বলে? ও বাংলা ব্যাকরণের আলোচ্য বিষয়
বাংলা ব্যাকরণ কাকে বলে?
বাংলা ব্যাকরণ (বি+ আ + √ কৃ + অন) শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থ বিশেষভাবে বিশ্লেষণ।
বাংলা ব্যাকরণ কি?
যে শাস্ত্রে কোনো ভাষার বিভিন্ন উপাদানের প্রকৃতি ও স্বরূপের বিচার-বিশ্লেষণ করা হয় এবং বিভিন্ন উপাদানের সম্পর্ক নির্ণয় ও প্রয়োগবিধি বিশদভাবে আলোচিত হয়, তাকে বাংলা ব্যাকরণ বলে।
বাংলা ব্যাকরণ পাঠের প্রয়োজনীয়তা
ব্যাকরণ পাঠ করে ভাষার বিভিন্ন উপাদানের গঠন প্রকৃতি ও সেসবের সুষ্ঠু ব্যবহারবিধি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায় এবং লেখায় ও কথায় ভাষা প্রয়োগের সময় শুদ্ধাশুদ্ধি নির্ধারণ সহজ হয়। যে শাসেত্র বাংলা ভাষার বিভিন্ন উপাদানের গঠনপ্রকৃতি ও স্বরূপ বিশ্লেষিত হয় এবং এদের সম্পর্ক ও সুষ্ঠু প্রয়োগবিধি আলোচিত হয়, তাই বাংলা ব্যাকরণ।
ভাষার মৌলিক অংশ কয়টি?
প্রত্যেক ভাষারই চারটি মৌলিক অংশ থাকে।
যেমন:
- ধ্বনি (Sound)
- শব্দ (Word)
- বাক্য (Sentence)
- অর্থ (Meaning)
সব ভাষার ব্যাকরণেই প্রধানত নিম্নলিখিত চারটি বিষয়ের আলোচনা করা হয় –
- ধ্বনিতত্ত্ব (Phonology )
- শব্দতত্ত্ব বা রূপতত্ত্ব ((Morphology)
- বাক্যতত্ত্ব বা পদকম (Syntax) এবং
- অর্থতত্ত্ব (Semantics)
এ ছাড়া অভিধানতত্ত্ব (Lexicography) ছন্দ ও অলংকার প্রভৃতিও ব্যাকরণের আলোচ্য বিষয়।
ধ্বনিতত্ত্ব কাকে বলে?
মানুষের বাক প্রত্যঙ্গ অর্থাৎ কণ্ঠনালি, মুখবিবর, জিহ্বা, আল-জিহ্বা, কোমল তালু, শত্রু তালু, দাঁত, মাড়ি, চোয়াল, ঠোঁট ইত্যাদির সাহায্যে উচ্চারিত আওয়াজকে ‘ধ্বনি’ বলা হয়। বাক প্রত্যঙ্গজাত ধ্বনির সূক্ষ্মতম মৌলিক অংশ বা একককে (Unit) ধ্বনিমূল (Phoneme) বলা হয়। বাংলা ব্যাকরণ ও এর আলোচ্য বিষয়
বর্ণ বা Letter কাকে বলে?
বাক প্রত্যঙ্গজাত প্রত্যেকটি ধ্বনি এককের জন্য প্রত্যেক ভাষায়ই লেখার সময় এক একটি প্রতীক বা চিহ্ন (Symbol) ব্যবহৃত হয়।
বাংলায় এ প্রতীক বা চিহ্নকে বলা হয় বর্ণ (Letter)।
যেমন:
বাংলায় ‘বক’ কথাটির প্রথম ধ্বনিটির প্রতীক রূপে ব্যবহার করা হয়েছে ‘ব’, ইংরেজিতে সে ধ্বনির জন্য ব্যবহৃত হয় B বা b (বি); আবার আরবি, ফারসি ও উর্দুতে একই ধ্বনির জন্য ব্যবহৃত হয় ~ (বে)।
ধ্বনির উচ্চারণপ্রণালী, উচ্চারণের স্থান, ধ্বনির প্রতীক বা বর্ণের বিন্যাস, ধ্বনিসংযোগ বা সন্ধি, ধ্বনির পরিবর্তন ও গোপ, ণত্ব ও ষত্ব বিধান ইত্যাদি বাংলা ব্যাকরণে ধ্বনিতত্ত্বের আলোচ্য বিষয়।
রূপতত্ত্ব কাকে বলে?
এক বা একাধিক ধ্বনির অর্থবোধক সম্মিলনে শব্দ তৈরি হয়, শব্দের ক্ষুদ্রাংশকে বলা হয় রূপ (morpheme)। রূপ গঠন করে শব্দ। সেই জন্য শব্দতত্ত্বকে রূপতত্ত্ব (Morphology) বলা হয়।
বাক্যতত্ত্ব কাকে বলে?
বাক্য Sentence: মানুষের বাপ্রত্যাজাত ধ্বনি সমন্বয়ে গঠিত শব্দসহযোগে সৃষ্ট অর্থবোধক বাক প্রবাহের বিশেষ বিশেষ অংশকে বলা হয় বাক্য (Sentence)। বাক্যের সঠিক গঠনপ্রণালী, বিভিন্ন উপাদানের সংযোজন, বিয়োজন, এদের সার্বক ব্যবহারযোগ্যতা, বাক্যমধ্যে শব্দ বা পদের স্থান বা ক্রম, পদের রূপ পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয় বাক্যতত্ত্বে আলোচিত হয়।
বাক্যের মধ্যে কোন পদের পর কোন পদ বসে, কোন পদের স্থান কোথায় বাক্যতত্ত্বে এসবের পূর্ণ বিশ্লেষণ থাকে। বাক্যতত্ত্বকে পদক্রমও বলা হয়।
অর্থতত্ত্ব কাকে বলে?
শব্দের অর্থবিচার, বাক্যের অর্থবিচার, অর্থের বিভিন্ন প্রকারভেদ।
যেমন:
মুখ্যার্থ, গৌণার্থ, বিপরীতার্থ ইত্যাদি অর্থতত্ত্বের আলোচ্য বিষয়।
বাংলা ব্যাকরণের আলোচনায় ব্যবহৃত কতিপয় পারিভাষিক শব্দ
বাংলা ব্যাকরণের আলোচনার জন্য পণ্ডিতেরা কতিপয় পারিভাষিক শব্দ ব্যবহার করেছেন। এ ধরনের প্রয়োজনীয় কিছু পারিভাষিক শব্দের পরিচয় নিম্নে প্রদান করা হলো:
প্রাতিপদিক
বিভক্তিহীন নাম শব্দকে প্রাতিপদিক বলে।
যেমন: হাত, বই, কলম ইত্যাদি।
সাধিত শব্দ কাকে বলে?
মৌলিক শব্দ ব্যতীত অন্য সব শব্দকেই সাধিত শব্দ বলে।
যথা-
হাতা, ইত্যাদি।
সাধিত শব্দ কত প্রকার?
সাধিত শব্দ দুই প্রকার:
- নাম শব্দ ও
- ক্রিয়া।
প্রত্যেকটি বা নামশব্দের প্রকৃতি ও প্রত্যয়। ক্রিয়ার দুটি অংশ থাকে।
প্রকৃতি ও প্রত্যয় কাকে বলে?
যে শব্দকে কোনো শব্দের যে অংশকে আর কোনো ক্ষুদ্রতর অংশে ভাগ করা যায় না, তাকে প্রকৃতি বলে।
প্রকৃতি প্রধানত দুই প্রকার
- নাম প্রকৃতি
- ক্রিয়া প্রকৃতি বা ধাতু।
নাম প্রকৃতি
হাতল, ফুলেল, মুখর- এ শব্দগুলো বিশ্লেষণ করলে আমরা পাই হাত + দ হাতল (বাট),
ক্রিয়া প্রকৃতি
আবার চলন্ত, জমা ও লিখিত- এ শব্দগুলো বিশ্লেষণ করলে আমরা পাই √চল্+অন্ত= চলন্ত (চলমান), জম্ + আ জমা (সঞ্চিত) এবং লিথ্ + ইত লিখিত (যা লেখা হয়েছে)।
এখানে চলু, জম্ ও লিখ – এ তিনটি ক্লিয়ামূল বা ক্রিয়ার মূল অংশ। এগুলোকে বলা হয় ক্রিয়া প্রকৃতি বা ধাতু।
প্রত্যয় শব্দ গঠনের উদ্দেশ্যে নাম প্রকৃতির এবং ক্রিয়া প্রকৃতির পরে যে শব্দাংশ যুক্ত হয় তাকে প্রত্যয় বলে। কয়েকটি শব্দের প্রকৃতি ও প্রত্যয় বিশ্লেষণ করে দেখানো হলো।
প্রত্যয় কত প্রকার?
বাংলা শব্দ গঠনে দুই প্রকার প্রত্যয় পাওয়া যায়।
- তদ্ধিত প্রত্যয় ও
- কৃৎ প্রত্যয়।
তদ্ধিত প্রত্যয় কি?
শব্দমূল বা নাম প্রকৃতির সঙ্গে যে প্রত্যয় যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ তৈরি হয়, তাকে বলে তদ্ধিত প্রত্যয়।
যেমন:
হাতল, ফুলেল ও মুখর শব্দের যথাক্রমে ল, এল এবং র তদ্ধিত প্রত্যয়।
কৃৎ প্রত্যয় কাকে বলে?
ধাতু বা ক্রিয়া প্রকৃতির সাথে যে প্রত্যয় যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ তৈরি হয়, তাকে বলে কৃৎ প্রত্যয়।
উদাহরণে চলন্ত, জমা ও লিখিত শব্দের যথাক্রমে অন্ত, আ এবং ইত কৃৎ প্রত্যয়।
কৃদন্ত শব্দ কাকে বলে?
তদ্ধিত প্রত্যয় সাধিত শব্দকে বলা হয় তদ্ধিতান্ত শব্দ এবং কৃৎ প্রত্যয় সাধিত শব্দকে বলা হয় কৃদন্ত শব্দ।
যেমন:
হাতল, ফুলে ও মুখর তন্দ্বিতান্ত শব্দ এবং চলন্ত, জমা ও লিখিত কৃদন্ত শব্দ।
উপসর্গ কাকে বলে?
শব্দ বা ধাতুর পূর্বে কতিপয় সুনির্দিষ্ট অব্যয় জাতীয় শব্দাংশ যুক্ত হয়ে সাধিত শব্দের অর্থের পরিবর্তন, সম্প্রসারণ ও সংকোচন ঘটিয়ে থাকে। এগুলোকে বলা হয় উপসর্গ।
বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত উপসর্গগুলোর নিজস্ব কোনো অর্থ না থাকলেও শব্দ বা ধাতুর পূর্বে ব্যবহৃত হলেই অর্থবাচকতা সূচিত হয়।
যেমন: ‘পরা’ একটি উপসর্গ, এর নিজস্ব কোনো অর্থ নেই। কিন্তু ‘জয়’ শব্দের পূর্বে যুক্ত হয়ে হলো ‘পরাজয়’। এটি জয়ের বিপরীতার্থক। সেইরূপ ‘দর্শন’ অর্থ দেখা।
এর আগে ‘প্র’ উপসর্গ যুক্ত হয়ে হলো ‘প্রদর্শন’ অর্থাৎ সম্যকরূপে দর্শন বা বিশেষভাবে দেখা।
উপসর্গ কত প্রকার?
বাংলা ভাষায় তিন প্রকারের উপসর্গ দেখা যায় :
- সংস্কৃত
- বাংলা
- বিদেশি উপসর্গ।
সংস্কৃত উপসর্গ কাকে বলে?
প্র, পরা, অপ-এরূপ বিশটি সংস্কৃত বা তৎসম উপসর্গ রয়েছে। তৎসম উপসর্গ তৎসম শব্দ বা ধাতুর পূর্বে ব্যবহৃত হয়।
যেমন: ‘পূর্ণ’ একটি তৎসম শব্দ। ‘পরি’ উপসর্গযোগে হয় ‘পরিপূর্ণ।
√হ (হর)+ঘঞ ‘হার’-এ কৃদন্ত শব্দের আগে উপসর্গ যোগ করলে কীরূপ অর্থের পরিবর্তন হলো লক্ষ কর : আ+হার আহার (খাওয়া), বি + হার বিহার (ভ্রমণ), উপ+হার-উপহার (পারিতোষিক), পরি+হার পরিহার (বর্জন) ইত্যাদি।
বাংলা উপসর্গ কাকে বলে?
অ, অনা, অঘা, অজ, আ, আব, নি ইত্যাদি অব্যয় জাতীয় শব্দাংশ বাংলা উপসর্গ। খাটি বাংলা শব্দের আগে এগুলো যুক্ত হয়।
যেমন: অ+কাজ-অকাজ, অনা+ছিষ্টি (সৃষ্টি শব্দজাত) = অনাছিষ্টি ইত্যাদি।
বিদেশি উপসর্গ কাকে বলে?
কিছু বিদেশি শব্দ বা শব্দাংশ বাংলা উপসর্গরূপে ব্যবহৃত হয়ে অর্থের বৈচিত্র্য সৃষ্টি করে। বিদেশি উপসর্গ বিদেশি শব্দের সঙ্গেই ব্যবহৃত হয়।
যথা: বেহেড, লাপাত্তা, গরহাজির ইত্যাদি।
অনুসর্গ কাকে বলে?
বাংলা ভাষায় যারা, দিয়া, কর্তৃক, চেয়ে, থেকে, উপরে, পরে, প্রতি, মাঝে, বই, ব্যতীত, অবধি, হেতু, জন্য, কারণ, মতো, তবে ইত্যাদি শব্দ কখনো অন্য শব্দের সঙ্গে যুক্ত না হয়ে স্বাধীনভাবে পদরূপে বাক্যে ব্যবহৃত হয়, আবার কখনো কখনো শব্দবিভক্তির ন্যায় অন্য শব্দের সঙ্গে প্রযুক্ত হয়ে অর্থবৈচিত্র্য ঘটিয়ে থাকে। এগুলোকে অনুসর্গ বলা হয়।
যেমন—কেবল আমার জন্য তোমার এ দুর্ভোগ। মনোযোগ দিয়ে শোন, শেষ পর্যন্ত সবার কাজে আসবে। বাংলা ব্যাকরণ ও এর আলোচ্য বিষয়