পদার্থ

নিউট্রন নক্ষত্র এবং কিছু ঘনতম পদার্থের উদাহরণ

ঘনতম পদার্থের উদাহরণ এবং নিউট্রন নক্ষত্র

মহাবিশ্বের এখনও পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে জানা সর্বাপেক্ষা ঘন বস্তু হল- নিউট্রন নক্ষত্র। এর চেয়েও ঘন হল ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর কিন্তু তাতে প্রায় অসীম ঘনত্বে থাকা বস্তু আদৌ কি দশায় থাকে তা এখনও অজানা তাই স্বাভাবিক বস্তুদের কথা ভাবলে নিউট্রন নক্ষত্র ব্রহ্মাণ্ডের ঘনতম বস্তু।

এরা হল বিরাট ভরের নক্ষত্ররা নিজেরই মহাকর্ষের দ্বারা চুপসে গিয়ে সৃষ্টি হওয়া শুধুমাত্র নিউট্রন কণা দ্বারা গঠিত নক্ষত্র। এদের ঘনত্ব এতটাই অকল্পনীয় রকমের বেশী যে এক চামচ নিউট্রন নক্ষত্রের পদার্থের ওজন হবে ১০০ কোটি টন অর্থাৎ ১ লক্ষ কোটি কেজি।

 

কিভাবে নিউট্রন নক্ষত্র জন্ম নেয়?

এর জন্য আমাদের তারার জীবনকাহিনী সংক্ষেপে জানতে হবে।

একটি তারার ভ্রূণাবস্থা বলা যেতে পারে বিশালমাপের চরকি খাওয়া গ্যাসীয় মেঘকে যার বেশিরভাগটাই হল হাইড্রোজেন। এই গ্যাসের মেঘের কলেবরটি হয় রীতিমত বড়, আমাদের সৌরজগতও মাপে তার চেয়ে ছোটই হবে। এই মেঘ ঘুরতে থাকে তার ঘন কেন্দ্রটিকে ঘিরে; গ্যাসীয় মেঘের নিজেরই কেন্দ্রের ঘন অংশের মহাকর্ষ ঘোরাতে থাকে চারপাশের গ্যাসকে। ঘুরতে ঘুরতে এই মহাকর্ষের টানেই তার মাঝখানটি হতে থাকে ঘন থেকে ঘনতর আর একইসাথে বাড়তে থাকে সেখানকার উষ্ণতাও। বাড়তে বাড়তে একসময় এটা যথেষ্ট গরম হয়ে বসে আর অমনি দুম করে তার তাপ-পারমানবিক নিউক্লীয় সংযোজন চুল্লীটা জ্বলে ওঠে একদিন যাতে হাইড্রোজেন ফিউশন হয়ে তৈরি হয় হিলিয়াম। জন্ম হয় একটা নতুন তারার।

See also  হলোগ্রাফি কাকে বলে, কিভাবে কাজ করে ও এর ব্যবহার

কিন্তু মহাকর্ষের পীড়ন তাতে বন্ধ হয়না, ভেতরের দিকে ক্রমেই চাপতে থাকে সে (Gravitational collapse); কিন্তু উলটোদিকের নিউক্লীয় বিক্রিয়ার তাপের চাপ (Thermal pressure) মাথা নোয়ায় না তার কাছে; গোঁয়ারের মত দাবিয়ে রাখে সে মহাকর্ষের পেষণকে আর এভাবেই এই মহাজাগতিক ঠেলাঠেলিতে দুইদিকের দুই মহাশক্তিমান খেলোয়াড় সমান শক্তিতে ‘ব্যালান্স’ করে রাখে ব্যাপারটাকে বহুকোটি থেকে বহুশতকোটি বছর। এটাই হয় একটি তারার জীবনের সবচেয়ে শান্ত আর স্থায়ী অবস্থা (Main sequence)। আমাদের সূর্য আছে এখন এই মূল পর্যায়েই।

বিশাল মেঘপুঞ্জ থেকে তারা ও গ্রহজগতের জন্ম

এই মূল পর্যায়ের পরই তারার জীবনে অশান্তির দিন ঘনিয়ে আসে। জ্বলতে জ্বলতে তারার হাইড্রোজেনরূপী জ্বালানী শেষ হয়ে আসে একদিন- তারার ঘরে দেখা দেয় তাপশক্তির বাড়ন্ত। তার আর ক্ষমতা থাকেনা মহাকর্ষের চাপকে ঠেলে ধরে রাখার। ফলে হঠাৎ করেই তারার বিশাল দেহটা চুপসে যেতে শুরু করে ভীষণভাবে। সূর্যের মাপের তারার ক্ষেত্রে ভেতরের দিকে এই হঠাৎ সংকোচনের ফলে প্রতিক্রিয়া হিসেবে বাইরের দিকেও একটা প্রবল আঘাত আসে যার ফলে তারার বাইরের গ্যাসের আবরণটা ভয়ানক ফুলে ওঠে আর তারার চেহারাটা হয়ে দাঁড়ায় আগের চেয়ে বহুগুণে বিশাল আর তার রঙ হয়ে যায় টকটকে লাল- একে বলা হয় ‘লোহিতদানব তারা’ (Red Giant star)।

See also  ট্রানজিস্টর কি এবং ট্রানজিস্টর কিভাবে কাজ করে?

আজ থেকে বহুকাল পর সূর্যের অবস্থাটা হবে এমনি একটি ‘লোহিতদানব তারা’ যার বিশাল দেহ গ্রাস করবে অন্তত প্রথম দুটি বা তিনটি গ্রহকে, শস্যশ্যামলা পৃথিবীর অবস্থা হবে সুধুমাত্র একটি জলন্ত কাঠকয়লার মত বীভৎস। আমাদের পিতাই হবে আমাদের নিষ্ঠুর হত্যাকারী। তবে এই নিশ্চিত ভয়ংকর ভবিষ্যৎ-এর কথা ভেবে আজ থেকেই কেউ যেন মনের দুঃখে Quora থেকে অবসর না নেন কারণ এটি ঘটবে আজ থেকে প্রায় কয়েকশো কোটি বছর পরে।

 

লোহিত দানব সূর্যের কবলে পৃথিবী

তবে এই বিশাল লোহিতদানব তারাও একদিন আবার সমস্ত গ্যাস মহাশূন্যে ছড়িয়ে দিয়ে পৃথিবীর মত আকারের ছোট্ট একটা তারায় পরিণত হয়। এর নাম ‘শ্বেতবামন তারা’ (White Dwarf star)।

 

শ্বেতবামন ক্ষীণকায় সূর্য,সামনে পৃথিবী অন্তিম রূপে

এর মধ্যে মহাকর্ষের চাপে ঠাসাঠাসি হয়ে আসা পরমাণুদের ইলেকট্রনগুলির এক উলটো চাপ (Electron Degeneracy pressure) আবার বাধা দিয়ে বসে মহাকর্ষকে এবং স্থিতাবস্থা লাভ করে। কিন্তু অবশেষে একদিন খরুচে বেকার শ্বেতবামন তারার শেষ তাপের সম্বলটুকুও ফুরিয়ে আসে আর তারার জ্বলন্ত দেহখানি সকল তেজ হারিয়ে ‘কৃষ্ণবামন’ (Black Dwarf) রূপে চাঁদের মত ঠাণ্ডা পাথুরে একটা টুকরোর মত পরে থাকে আকাশের কোণে।

কিন্তু যদি শ্বেতবামন তারার মাপ হয় সূর্যের চেয়েও অনেক বড় (সূর্যের ভরের ১.৪ গুণ- একে বলে চন্দ্রশেখর সীমা) তবে শ্বেতবামন হয়েই সে স্থিত হতে পারেনা। এইরকম শ্বেতবামনের জন্ম হতে পারে বিরাট ভরের তারাদের থেকে যাদের প্রাথমিক ভর হয় সূর্যের ভরের ১০ থেকে ২৯ গুণ।

See also  আইনস্টাইন এর গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার বা কাজ সমুহ

এমন বিরাট মাপের একখানি তারা যখন মূল পর্যায় থেকে এসে পৌঁছায় নিউক্লীয় চুল্লীর শেষ অবস্থায়, মহাকর্ষের প্রচণ্ড পেষণে তারার কেন্দ্র আরও আরও বেশি চুপসে গিয়ে ঘন হতে থাকে। তারকাকেন্দ্রের দুর্দান্ত চাপের চোটে একসময় তারার মধ্যে ঘটে যায় এক সাঙ্ঘাতিক বিস্ফোরণ আর তাতে বাইরের বিশাল পরিমাণ অংশ ফেটে পড়ে একেবারে তছনছ হয়ে যায়। এই বিস্ফোরণকেই বলা হয় সুপারনোভা। এই বিস্ফোরণ এতটাই শক্তি ধরে যে অল্পসময়ের জন্য আকাশের সমস্ত তারার আলো এর শক্তির কাছে ম্লান হয়ে যায়।

একহাজার বছর আগের সুপারনোভা বিস্ফোরণে সৃষ্ট ক্রমবর্ধমান ক্র্যাব নেবুলা

সুপারনোভা বিস্ফোরণ ঘটে গেলেও পড়ে থাকা অবশিষ্ট দেহটাও যদি হয়ে দাঁড়ায় চন্দ্রশেখর সীমার চেয়ে বড় তাহলে পূর্বের মত ইলেকট্রনদের উলটো চাপও আর থামাতে পারেনা মহাকর্ষকে আর এর অসম্ভব পীড়নে এবার পরমানুগুলিও হারাতে শুরু করে নিজেদের স্বরূপ। ইলেকট্রন আর নিউক্লিয়াসের প্রোটনেরা একেবারে অন্ধকূপ হত্যার মত ঠাসাঠাসি অবস্থায় চলে গিয়ে তৈরি করে বসে শুধু নিউট্রন আর তাতে প্রায় সম্পূর্ণ তারাটাই নিমেষের মধ্যে মূলত নিউট্রন দিয়ে তৈরি মাত্র একটা শহরের মত ছোট এক তারার জন্ম দেয়। শেষপর্যন্ত নিউট্রনদের এক উলটো চাপ (Neutron Degeneracy pressure) মহাকর্ষের শাসন থেকে একে রক্ষা করে। একেই বলা হয় ‘নিউট্রন নক্ষত্র’।

Related Articles

Back to top button