ওয়ার্ম হোল এবং সময় ভ্রমণ
ওয়ার্ম হোল এবং সময় ভ্রমণ সম্পর্কে বিস্তারিত।
এই প্রশ্নের উত্তর বুঝতে হলে আপেক্ষিকতা তত্ত্ব সম্পর্কে কিছুটা ধারনা থাকতে হবে। আগে জেনে নেই ওয়ার্ম হোল কি?
ওয়ার্ম হোল কি?
১৯১৬ সালে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব থেকে তাত্ত্বিকভাবে সর্বপ্রথম ওয়ার্ম হোল এর ধারনা করা হয়েছিল। যদিও তখন একে এই নামে ডাকা হত না।
ওয়ার্মহোল হচ্ছে স্থান-কালের একটি টপোলজিকাল বৈশিষ্ট্য যা মৌলিকভাবে মহাবিশ্বের দুই প্রান্ত বা দুই মহাবিশ্বের মধ্যে স্থান-কালের ক্ষুদ্র সুড়ঙ্গপথ বা “শর্টকাট”। যদিও গবেষকরা এখনো ওয়ার্মহোল পর্যবেক্ষণ করতে পারেননি তবে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার সমীকরনে এর বাস্তব সমাধান রয়েছে, কারণ এর তাত্ত্বিক শক্তি খুব জোরালো।
ওয়ার্ম হোল কল্পনা করার জন্য একটা দ্বিমাত্রিক তল, যেমন কাগজ তলের কথা ভাবুন। এর এক স্থানে রয়েছে একটি ছিদ্র যা থেকে একটি ত্রিমাত্রিক টিউব বা সুড়ঙ্গ বের হয়, এবং সেটি কাগজের অন্য একটি অংশে আরেকটি ছিদ্রে গিয়ে মিলিত হয়। দ্বিমাত্রিক কাগজের উপর দিয়ে দুটি ছিদ্রের দূরত্ব বেশি হলেও সুড়ঙ্গ দিয়ে দূরত্ব কম, কারণ এটি কাগজটিকে ত্রিমাত্রিকভাবে বাঁকিয়ে নিয়ে সুড়ঙ্গপথটির দৈর্ঘ্য কমিয়ে দিয়েছে। ওর্মহোলের ব্যাপারটাও অনেকটা এমন, যদিও এখানে দ্বিমাত্রিক কাগজ পৃষ্ঠের বদলে রয়েছে ত্রিমাত্রিক মহাকাশ, এবং ত্রিমাত্রিক সুড়ঙ্গের বদলে রয়েছে চতুর্মাত্রিক ওয়ার্মহোল।
ওয়ার্ম হোলের কাল্পনিক চিত্র।
ওয়ার্মহোল এবং সময় ভ্রমণের প্রাথমিক ধারণা
১৯৮০ এর দশকে, ক্যালিফোর্নিয়ার ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির থিওরিটিক্যাল ফিজিক্স এর অধ্যাপক থর্ন, কোনও বস্তু (যেমনঃ স্পেসশিপ) কোনও ওয়ার্মহোল এর মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করতে পারে কিনা সে সম্পর্কে পদার্থবিদদের মধ্যে আলোচনা শুরু করেছিলেন। থর্ন সহ অন্যান্য পদার্থবিদরা এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার ব্যাপারে কিছুটা অগ্রগতি করে ফেলেছিলেন। থর্ন যখন ওয়ার্মহোলকে মহাকাশ ভ্রমণের জন্য ব্যবহার করার সম্ভাবনা বিবেচনা করতে শুরু করেন, তখন তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে ওয়ার্মহোল আসলে সময় ভ্রমণের জন্যও ব্যবহার করা যেতে পারে।
১৯৯৪ সালে তাঁর “ব্ল্যাক হোলস অ্যান্ড টাইম ওয়ার্পস” বইয়ে থর্ন মনে মনে একটি পরীক্ষার প্রস্তাব করেছিলেন: ধরা যাক আমরা একটি ওয়ার্মহোল পেয়েছি, যা স্থানের দুটি পয়েন্টকে এমনভাবে সংযুক্ত করে যেন তাদের মধ্যে কোন দূরত্ব ই নেই। থর্ন এই ওয়ার্মহোল এর এক প্রান্ত তার বসার ঘরে রাখে, এবং অন্য প্রান্তটি রাখে তার লনে পার্ক করে রাখা একটি স্পেসশিপে। থর্নের স্ত্রী ক্যারোলি মহাকাশ ভ্রমণের জন্য স্পেসশিপে উঠলেন। স্পেসশিপ এ উঠার আগে দুজন দু’জনকে বিদায় জানানোর প্রয়োজন হবে না, কারন করালি যতই দূরে ভ্রমণ করেন না কেন, তারা একে অপরকে ওয়ার্মহোল দিয়ে দেখতে পাবেন! এমনকি তারা একে অপরের হাত ধরে রাখতে পারবেন!
সময় ভ্রমণ কি?
ক্যারোলি স্পেসশিপ চালুু করে মহাকাশে চলে যান এবং আলোর গতিতে ছয় ঘন্টা ভ্রমণ করেন। তারপরে তিনি ঘুরে ফিরে একই গতিতে বাসায় ফিরে আসেন – মানে ১২ ঘন্টার রাউন্ড ট্রিপ। থর্ন কিন্তু ওয়ার্মহোলের মধ্য দিয়ে এই ভ্রমণটি দেখেছেন। তিনি দেখেন যে ক্যারোলি তার ভ্রমণ থেকে ফিরে এসেছেন, সামনের লনে অবতরণ করেছেন, স্পেসশিপ থেকে বের হয়ে ঘরে ঢুকলেন।
কিন্তু থর্ন যখন নিজের পৃথিবীতে ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকান, তখন তার সামনের লনটি খালি দেখবেন! তিনি দেখবেন ক্যারোলি তখনো ফেরেনি! যেহেতু ক্যারোলি আলোর গতিতে ভ্রমণ করেছিলেন, সময় তার জন্য ধীর হয়ে পড়েছিল। ক্যারোলি জন্য যা ছিল ১২ ঘন্টা, তা পৃথিবীতে থর্নের জন্য ছিল ১০ বছর! এখন, থর্ন এবং ক্যারোলি ওয়ার্মহোলের মধ্য দিয়ে হাত ধরে ছিলেন, তারা প্রত্যেকে সময় ভ্রমণ করছিলেন। ক্যারালি তার চলে যাওয়ার ১০ বছর পরে পৃথিবীতে অবতরণ করেছেন এবং সেখানে তিনি তার চেয়ে ১০ বছরের বড় থর্নের সাথে দেখা করবেন! তবে তিনি যদি লনে না নেমে ওয়ার্মহোলের ভিতর দিয়ে গিয়ে থর্নকে দেখেন, তাহলে মাত্র ১২ ঘণ্টা পার করা থর্নকে দেখতে পাবেন! আবার থর্ন যদি ওয়ার্মহোলে পা রাখেন, তাহলে তিনি ১০ বছর পরের নিজেকে খুঁজে পাবেন আর ওয়ার্মহোল থেকে বসার ঘরে নেমে গেলে ১০ বছর আগের নিজেকে দেখতে পাবেন!
এটি আসলে থর্নের একটি ‘চিন্তার পরীক্ষা (thought experiment)’ যা আরো বৃহত্তর একটি প্রশ্নের উত্তর দেয়, সেটা হল – সময় ভ্রমণ কি এই মহাবিশ্বের নিয়ম দ্বারা নিষিদ্ধ? আমরা জানি যে উচ্চ গতিতে বা খুব উচ্চ মাধ্যাকর্ষণযুক্ত অঞ্চলে সময় ধীরে ধীরে চলে (এটি “ইন্টারস্টেলার” মুভিতে দেখানো হয়েছিল)। সুতরাং, মহাবিশ্বের নিয়ম অনুসারে “ভবিষ্যতে” ভ্রমণ নিষিদ্ধ নয়। এটি আসলেই সম্ভব।
ওয়ার্ম হোলের তাত্ত্বিক অস্তিত্ব আছে কি?
তাত্ত্বিকভাবেই এর অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা গিয়েছে, এখনও দৃশ্যমান ওয়ার্মহোল পাওয়া যায়নি।
আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব থেকে গাণিতিকভাবে এর অস্তিত্বের ব্যাপারে অনুমান করা হয়। বলা হয় এটি মহাবিশ্বের দুই স্থানের মধ্যে কিংবা আলাদা কোন মহাবিশ্বের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম। মানে বিলিয়ন আলোকবর্ষ পথ এটা কয়েক মিটারে পরিণত করতে সক্ষম। তবে স্পেস-টাইম ফেব্রিকে এমন টানেল তৈরি হতে/করতে অভাবনীয় শক্তি ও ভর দরকার হবে।
একটা লম্বাটে আকারের কাগজ নিন। ধরুন এর দৈর্ঘ্য ২ ফুট। এবার কাগজটি মাঝামাঝি ভাজ করে এর প্রান্তে পেন্সিল দিয়ে ছিদ্র করুন। এখন লক্ষ্য করুন আগে কাগজের এক প্রান্ত থেকে একটা পিঁপড়াকে ছেড়ে দিলে অপর প্রান্তে যেতে এর দুই ফুট পথ পাড়ি দিতে হতো, আর এখন ওই ছিদ্র দিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই যেতে পারবে!